মাধ্যমিকে ছাত্র-বৃদ্ধি কম কেন, সমীক্ষায় পর্ষদ

মাধ্যমিকের জন্মলগ্ন থেকেই সংখ্যার বিচারে ছাত্রদের তুলনায় পিছিয়ে থাকত ছাত্রীরা। গত কয়েক বছরে সেই ধারায় ছেদ পড়েছে। গত দু’তিন বছরে পাশের হারে এগিয়ে থাকলেও সংখ্যার বিচারে মাধ্যমিকে ছেলেদের বেশ খানিকটা পিছনে ফেলে দিচ্ছে মেয়েরা। শুধু তা-ই নয়। ছাত্রীর সংখ্যা যে-হারে বাড়ছে, ছাত্র-সংখ্যা বাড়ছে তার তুলনায় কম হারে।

Advertisement

সাবেরী প্রামাণিক

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৪ মে ২০১৪ ০৩:২৬
Share:

মাধ্যমিকের জন্মলগ্ন থেকেই সংখ্যার বিচারে ছাত্রদের তুলনায় পিছিয়ে থাকত ছাত্রীরা। গত কয়েক বছরে সেই ধারায় ছেদ পড়েছে। গত দু’তিন বছরে পাশের হারে এগিয়ে থাকলেও সংখ্যার বিচারে মাধ্যমিকে ছেলেদের বেশ খানিকটা পিছনে ফেলে দিচ্ছে মেয়েরা। শুধু তা-ই নয়। ছাত্রীর সংখ্যা যে-হারে বাড়ছে, ছাত্র-সংখ্যা বাড়ছে তার তুলনায় কম হারে। এর কারণ কী, খতিয়ে দেখা দরকার বলে মনে করছে স্কুলশিক্ষা দফতর।

Advertisement

এবং এটা যাচাইয়ের দায়িত্ব মধ্যশিক্ষা পর্ষদকেই দিয়েছেন ওই দফতরের কর্তারা। ফলপ্রকাশের কাজ মিটে যাওয়ায় এখন পর্ষদে কাজের চাপ কিছুটা কম। এ বার এই বিষয়টি বিশ্লেষণ করবে পর্ষদ। শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু বলেন, “আমরা শিক্ষায় লিঙ্গভেদে বিশ্বাস করি না। সংখ্যার এই হিসেবকে মাধ্যমিকের একটা বৈশিষ্ট্য হিসেবেই দেখা হচ্ছে। তবে কেন ছাত্র-সংখ্যা সে-ভাবে বাড়ছে না, কোথাও কোনও গলদ থেকে যাচ্ছে কি না, সেটা পর্ষদকে দেখতে হবে।”

মাধ্যমিক পরীক্ষায় ছাত্র-সংখ্যা বৃদ্ধির হার কতটা কম?

Advertisement

এ বারের মাধ্যমিকেই দেখা যাচ্ছে, ছাত্র-সংখ্যা চার লক্ষ ৮৯ হাজার ৫৬৪ আর ছাত্রী-সংখ্যা পাঁচ লক্ষ ৫৩ হাজার ১৫০। গত বারের তুলনায় ছাত্র-সংখ্যা বেড়েছে সাড়ে চার হাজারের কিছু বেশি আর ছাত্রী-সংখ্যা বেড়েছে সাড়ে ১৩ হাজারেরও বেশি। এই ঝোঁক যে কেবল এ বছরেরই, তা নয়। পর্ষদ জানিয়েছে, ২০১৩-য় চার লক্ষ ৮৮ হাজার ৬৪৮ জন ছাত্র এবং পাঁচ লক্ষ ৩৯ হাজা ২৯০ জন ছাত্রী মাধ্যমিক দিয়েছিল। ২০১২ সালে ছাত্র এবং ছাত্রীর সংখ্যা ছিল যথাক্রমে চার লক্ষ ৮৬ হাজার ৩২৮ এবং পাঁচ লক্ষ ১৯ হাজার ২০৫।

অথচ ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী রাজ্যে ৫১.৩৭ শতাংশ পুরুষ এবং ৪৮.৬৩ শতাংশ মহিলা। তা সত্ত্বেও কেন ছাত্র-সংখ্যা বৃদ্ধির হারে এই ঘাটতি, তা বোধগম্য হচ্ছে না পর্ষদের। সংস্থার প্রশাসক কল্যাণময় গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, “ছাত্র-সংখ্যা বৃদ্ধির হার ছাত্রীদের তুলনায় এতটা কম কেন, তা খতিয়ে দেখা হবে। স্কুলশিক্ষা দফতরও সেটা চাইছে। এই সমীক্ষায় সমাজবিজ্ঞানীদের সঙ্গে কথা বলে এগোতে চায় পর্ষদ।” ওই সংস্থা সূত্রের খবর, শুক্রবারেও এ ব্যাপারে দফতরের কর্তাদের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে পর্ষদ-কর্তৃপক্ষের।

এক সময় স্কুলের ক্লাসে ছেলে ও মেয়ের সংখ্যায় ভাল রকম ব্যবধান থাকত। কিন্তু এখন তা কমেছে। উল্টে মাধ্যমিকে অন্তত সংখ্যার বিচারে টেক্কা দিচ্ছে মেয়েরা। কী ভাবে?

স্কুলশিক্ষা দফতরের এক কর্তা বলেন, “অভিভাবকেরা তো বটেই, মেয়েরাও আজকাল অনেক সচেতন।” সেই সচেতনতা থেকেই নাবালিকাদের বিয়ে দেওয়ার প্রবণতা কমেছে। অনেক সময় পরিবারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াচ্ছে স্কুলপড়ুয়ারাও। বিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত বদলাতে বাধ্য করছে। এ ছাড়া স্কুলে গেলে মেয়েদের স্কুলের পোশাক দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে সম্প্রতি চালু হয়েছে রাজ্য সরকারের কয়েকটি প্রকল্প। কল্যাণময়বাবু যেমন বলন, “বাল্যবিবাহ রুখতে সরকার কন্যাশ্রী প্রকল্প চালু করেছে। একাদশ-দ্বাদশে মেয়েদের সাইকেল দেওয়া হচ্ছে, সেগুলিও আরও বেশি ছাত্রীকে স্কুলে আসতে আগ্রহী করবে।”

কিন্তু মেয়েদের মধ্যে পড়াশোনার প্রবণতা বাড়লে তো ছেলেদের ক্ষেত্রে সেটা কমে যেতে পারে না। তা হলে মাধ্যমিক পরীক্ষায় ছেলেদের সংখ্যা বাড়ার হার কমছে কেন?

সাদা চোখে এই কারণটা পরিষ্কার হচ্ছে না বলেই বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে বলে জানান পর্ষদ-কতৃপক্ষ। আর অভিজ্ঞ সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, এর কারণ মূলত দু’টি। l মেয়েদের লেখাপড়া শেখানোর প্রবণতা বাড়ছে সব স্তরের মানুষর মধ্যে। l মূলত অভাবের তাড়নায় স্কুলের বদলে কিশোরদের ছোটখাটো কাজে পাঠাতে বাধ্য হয় অনেক পরিবার। সর্বশিক্ষা অভিযান প্রকল্পের সাম্প্রতিক একটি সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, অষ্টম শ্রেণির পরে ৩৮.৫ শতাংশ ছাত্র স্কুলের পড়াশোনায় ইতি টেনেছে। মেয়েদের ক্ষেত্রে এই হার ২২.৭ শতাংশ।

প্রতীচী ট্রাস্টের প্রকল্প অধিকর্তা কুমার রানার কথায়, “কাজের খোঁজে অনেক কিশোরই রাজ্য ছেড়ে বেঙ্গালুরু, মহারাষ্ট্রে পাড়ি দেয়। কিন্তু বাবা-মায়েরা মেয়েদের যেখানে-সেখানে কাজে পাঠাতে চান না। বিয়ের আগে পর্যন্ত তারা তাই পড়াশোনাটা চালিয়ে যায়। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে এই প্রবণতা বেশি।” মধ্যশিক্ষা পর্ষদের তথ্যও কুমারবাবুর বক্তব্যের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে। তথ্য-পরিসংখ্যান অনুযায়ী এ বার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের এক লক্ষ ৪২ হাজার ৪১৫ জন ছাত্রী এবং ৯৮ হাজার ৭৭৪ জন ছাত্র মাধ্যমিক দিয়েছে।

সমাজতত্ত্ববিদ প্রশান্ত রায়, অভিজিৎ মিত্রও ছেলেদের স্কুলছুটের হার বৃদ্ধি এবং পড়াশোনায় তাদের অনাগ্রহকেই এর অন্যতম প্রধান কারণ বলে মনে করছেন। প্রশান্তবাবু বলেন, “ছোট মাপের সমীক্ষায় এমনই তথ্য পাওয়া যায়। বাবা-মায়েরাও অনেক সময় ছেলেদের পড়া ছেড়ে দেওয়ায় বাধা দেন না।”

কারণ হিসেবে বহু মত উঠে আসছে। কল্যাণময়বাবু জানান, কারণ যা-ই হোক, সেটা খুঁজে পাওয়া দরকার। তার প্রতিকারে ব্যবস্থা নেওয়াও জরুরি। সেই জন্য যত দ্রুত সম্ভব সমীক্ষা শুরু করতে চায় পর্ষদ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন