মন্ত্রীর গাড়িতে ঢিল পড়তেই সাসপেন্ড চার জন পুলিশকর্মী

বিজেপি-র অবরোধের সময়ে কৃষিমন্ত্রী পূর্ণেন্দু বসুর গাড়িতে ঢিল পড়ায় জগদ্দল থানার আইসি-সহ চার পুলিশকর্মীকে রাতারাতি সাসপেন্ড করে দেওয়া হল। যদিও পুলিশকর্মীরাই মন্ত্রীকে নিরাপদে বার করে নিয়ে গিয়েছিলেন। ঘটনাস্থল থেকে ২০ জন বিজেপি সমর্থককে গ্রেফতারও করা হয়। মন্ত্রী নিজে অবশ্য পুলিশকে দায়ী করেননি। তার পরেও এই সিদ্ধান্ত কেন নেওয়া হল, তা নিয়ে পুলিশ-প্রশাসনের সব স্তরেই প্রশ্ন উঠেছে।

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০৩:৩৮
Share:

বিজেপি-র অবরোধের সময়ে কৃষিমন্ত্রী পূর্ণেন্দু বসুর গাড়িতে ঢিল পড়ায় জগদ্দল থানার আইসি-সহ চার পুলিশকর্মীকে রাতারাতি সাসপেন্ড করে দেওয়া হল।

Advertisement

যদিও পুলিশকর্মীরাই মন্ত্রীকে নিরাপদে বার করে নিয়ে গিয়েছিলেন। ঘটনাস্থল থেকে ২০ জন বিজেপি সমর্থককে গ্রেফতারও করা হয়। মন্ত্রী নিজে অবশ্য পুলিশকে দায়ী করেননি। তার পরেও এই সিদ্ধান্ত কেন নেওয়া হল, তা নিয়ে পুলিশ-প্রশাসনের সব স্তরেই প্রশ্ন উঠেছে।

বৃহস্পতিবার জগদ্দল থানার শ্যামনগর বাসুদেবপুর মোড়ে কল্যাণী এক্সপ্রেসওয়েতে বিজেপির অবরোধে আটকে পড়েছিল কৃষিমন্ত্রীর গাড়ি। ঢিলে গাড়ির কাচ ফাটে। সে দিনই বিজেপির হামলার প্রতিবাদে জগদ্দল ও নৈহাটিতে মিছিল করে তৃণমূল।

Advertisement

শুক্রবারই উত্তর ২৪ পরগনার ব্যারাকপুর কমিশনারেটের তরফে জানিয়ে দেওয়া হয়, জগদ্দল থানার আইসি গৌতম চট্টোপাধ্যায়, মন্ত্রীর পাইলট গাড়ির দায়িত্বে থাকা এএসআই শিশিরকুমার কর্মকার, আরটি কন্ট্রোল এবং সিটি কন্ট্রোলে কর্তব্যরত দুই কনস্টেবল যথাক্রমে অশোক গোস্বামী ও বীরেন বিশ্বাসকে সাসপেন্ড করা হয়েছে।

ঘটনাচক্রে বৃহস্পতিবারই তৃণমূল নেতা সুদীপ্ত ঘোষের হাতে ‘প্রহৃত’ পুলিশকর্মী শামিম খানকে বীরভূমের বোলপুর থানা থেকে বদলি করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সুদীপ্ত বা তাঁর শাগরেদরা অধরাই। প্রকাশ্যে কেউ মুখ না খুললেও রাজ্য পুলিশের বহু অফিসার বা কর্মীই কিন্তু শাসকদলের চাপে কোণঠাসা হয়ে পড়ার কথা তুলছেন। গত ৩ সেপ্টেম্বর রাতে বোলপুরের ওই ঘটনার পরেই জেলা পুলিশ সুপার অলোক রাজোরিয়া মন্তব্য করেছিলেন, ‘পুলিশ কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে।’ পরে অবশ্য চাপের মুখে সেই বক্তব্যও তিনি প্রত্যাহার করে নেন।

এ বারের ঘটনাতেও প্রশ্ন উঠেছে, জগদ্দলের আইসি-র অপরাধ কী ছিল? কমিশনারেট সূত্রের দাবি, অবরোধ সম্পর্কে তিনি আগে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাননি। এমনকী, মন্ত্রীর গাড়ি আক্রান্ত হওয়ার পরেও কর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেননি। বাকি তিন জনের কাজের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব ছিল বলেও কমিশনারেট সূত্রের খবর।

মন্ত্রী কি পুলিশের ভূমিকা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন?

এ দিন পূর্ণেন্দুবাবু বলেন, “আমি কোথাও কোনও অভিযোগ করিনি, মৌখিক ভাবেও না। যে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, সে ব্যাপারে আমার কোনও ভূমিকা নেই।” তা হলে ব্যবস্থা নেওয়া হল কেন? পূর্ণেন্দুবাবুর বক্তব্য, “পুরোটাই প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত।” তবে কি প্রশাসনের নেওয়া এই ‘ব্যবস্থা’ তিনি সমর্থন করছেন না? কৃষিমন্ত্রী এই প্রশ্নের কোনও উত্তর দেননি।

স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠছে, এই অতি-সক্রিয়তা কেন? ব্যারাকপুর কমিশনারেটের একটি সূত্রের দাবি, ‘দোষী’ পুলিশকর্মীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য শাসকদলের চাপ ছিল। যদিও পুলিশ কমিশনার নীরজকুমার সিংহের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। বহু বার চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। এসএমএস-এরও জবাব দেননি। মুখ খোলেননি আইসি-সহ সাসপেন্ড হওয়া অন্য পুলিশকর্মীরা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে রাজ্য পুলিশের বহু কর্মীই কিন্তু প্রশাসনের ‘দ্বিচারিতা’ নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। তাঁদের প্রশ্ন যে রাজ্যে খুনে নাম জড়ালেও অনুব্রত মণ্ডলের মতো নেতাদের বিরুদ্ধে ‘ব্যবস্থা’ নেওয়া হয় না, ‘ঘরে ঘরে ছেলে ঢুকিয়ে’ দেওয়ার হুমকি সত্ত্বেও তাপস পালের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে বলে আদালতকে হস্তক্ষেপ করতে হয়, সেখানে পান থেকে চুন খসলেই তাঁদের উপরে কোপ পড়ছে কেন? কেন শাসকদলের নেতাদের আড়াল করতে গিয়ে তাঁদের আদালতে হেনস্থা হতে হচ্ছে? আবার নেতামন্ত্রীদেরই খেয়াল-খুশিতে যখন-তখন ‘বলির পাঁঠা’ হতে হচ্ছে?

গত ৩ সেপ্টেম্বর রাতে মদ্যপ অবস্থায় বোলপুর থানায় ঢুকে কর্তব্যরত অফিসারকে মারধরের অভিযোগ ছিল সুদীপ্ত ও তাঁর নয় শাগরেদের বিরুদ্ধে। তার পরেও পুলিশ প্রথমে অভিযোগ দায়ের করেনি। পরে জামিনঅযোগ্য ধারায় মামলা রুজু করা হয়। কিন্তু এত দিনেও অনুব্রত-ঘনিষ্ঠ ওই নেতাকে গ্রেফতার করা যায়নি (যদিও অনুব্রত নিজে কবুল করেছেন, সুদীপ্ত শহরেই রয়েছেন)। এরই মধ্যে মাত্র দু’মাস আগে বোলপুর থানায় কাজে যোগ দেওয়া শামিম খানকে নলহাটি থানায় সরিয়ে দেওয়া হল। ‘কঠিন সময়’ বলেই কি? পুলিশ সুপার অবশ্য এ দিন আর ফোন ধরেননি।

ঘটনা তো একটা নয়। একের পর এক। রাস্তায় তাঁর গাড়ি আটকানোর ‘অপরাধে’ কলকাতা পুলিশের এক কর্মীকে থাপ্পড় মারার অভিযোগ উঠেছিল মুখ্যমন্ত্রীর ভাইপো আকাশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে। পূর্ণেন্দুবাবুর বাড়ির অনুষ্ঠানে কলকাতা থেকে ডেকরেটর্সের মালপত্র যাওয়ার পথে বালি ব্রিজের আগে গাড়ি আটকানোয় পুলিশকর্মীকে চড় মারার অভিযোগ উঠেছিল শ্রমিক নেত্রী দোলা সেনের বিরুদ্ধেও। প্রশ্ন রয়েছে পুলিশের পদস্থ কিছু অফিসারের আচরণ নিয়েও। পাড়ুই-কাণ্ডে খোদ ডিজি-র ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলে মামলার তদন্তভার সিবিআইকে দিয়েছে হাইকোর্ট।

ব্যারাকপুর কমিশনারেটের এক কর্তার আক্ষেপ, “আমাদের অনেক ক্ষেত্রেই স্বাধীন ভাবে কাজ করতে দেওয়া হয় না। তাই সাধারণ মানুষের কাছে হেনস্থা হতে হয়। আবার লঘুপাপে দণ্ড দেওয়াও চলছে!” তাঁর প্রশ্ন, “এতে যে নিচুতলার কর্মীদের মনোবল ভেঙে যাচ্ছে, নেতারা সে কথাটা আর কবে বুঝবেন?”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন