সেক্টর ৫-এ রোজ ভ্যালির অফিসে ঢুকছেন ইডি কর্তারা। ছবি: শৌভিক দে।
সারদার পরে এ বার রোজ ভ্যালি।
বৃহস্পতিবার বিকেলে রোজ ভ্যালি সংস্থার সল্টলেক, বাগুইআটি ও বারাসতের অফিসে একযোগে তল্লাশি চালাল কেন্দ্রীয় সরকারের এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)। জমি বিক্রি ছাড়াও সংস্থাটির অন্য যে সব ব্যবসা ছিল এবং রয়েছে (হোটেল, রিসর্ট, ফিল্ম প্রযোজনা, সংবাদমাধ্যম ইত্যাদি), ইডি-র অফিসারেরা সে সবের কাগজপত্র খুঁটিয়ে দেখেন। তাঁদের দাবি, ওই তিনটি অফিস এবং বারাসতের এক অতিথিশালা থেকেও নথিপত্র আটক করা হয়েছে।
জমি বিক্রি ব্যবসার অঙ্গ হিসেবে অর্থলগ্নি সংস্থা খুলে বাজার থেকে টাকা তুলে তা নির্দিষ্ট সময়ের পরে সুদ-সহ লগ্নিকারীদের ফেরত দেওয়ার কারবার চালু করেছিল রোজ ভ্যালি। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সিকিওরিটিস অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ বোর্ড অব ইন্ডিয়া (সেবি)-র যে অনুমতি দরকার পড়ে, রোজ ভ্যালির তা ছিল না বলে অভিযোগ। তাই ২০১০ সালে সেবি’র নির্দেশে ওই কারবার তাদের গুটিয়ে ফেলতে হয়। অন্য দিকে ওড়িশায় তাদের বিরুদ্ধে আর্থিক তছরুপের মামলা রুজু হয়। প্রসঙ্গত, একই অভিযোগে সারদা-সহ অন্য ৪৩টি অর্থলগ্নি সংস্থার বিরুদ্ধেও ওড়িশার বিভিন্ন থানা এবং সিআইডি মামলা দাখিল করেছে। সম্প্রতি সারদা-মামলায় সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশ দিয়েছে, সারদা ছাড়াও রোজ ভ্যালি-সহ অন্য ৪৩টি সংস্থার বিরুদ্ধে সিবিআই তদন্ত চালাবে। পাশাপাশি ওই আর্থিক কেলেঙ্কারি নিয়ে ইডি-ও নিজের তদন্ত জোরদার করবে।
আর তারই জেরে এ দিন রোজ ভ্যালির তিনটি অফিসে ইডি-র এই যুগপৎ তল্লাশি। ইডি-সূত্রের খবর: ত্রিপুরা, ওড়িশা ও পশ্চিমবঙ্গে রোজ ভ্যালির অন্যান্য শাখাতেও প্রয়োজনে তল্লাশি হবে। সল্টলেকের পাঁচ নম্বর সেক্টরে একটি বাড়ির দু’টি তলায় প্রায় এক লক্ষ বর্গফুট এলাকা জুড়ে রোজ ভ্যালির দু’টি অফিস রয়েছে। সেখানে এ দিন গভীর রাত পর্যন্ত ইডি’র তল্লাশি চলে। “প্রয়োজনে রাতভর তল্লাশি চালাতে হবে।” বলেন ইডি’র এক অফিসার। সংস্থা-কর্তৃপক্ষের কী বক্তব্য?
রোজ ভ্যালি গোষ্ঠীর চেয়ারম্যান গৌতম কুণ্ডু এ দিন সন্ধ্যায় বলেন, “আমাদের তিনটি অফিসে ইডি-র অফিসারেরা তদন্তে এসেছিলেন। তাঁরা আমাদের বিভিন্ন ব্যবসা সংক্রান্ত কাগজপত্র দেখতে চান। ওঁদের চাহিদামতো আমরা সমস্ত নথি দেখিয়েছি। তদন্তে পূর্ণ সহযোগিতা করছি।” গৌতমবাবুর দাবি, “আগেও আমরা সেবি’কে তাদের চাহিদামতো সমস্ত কাগজপত্র দেখিয়েছি। সিবিআই-কেও পূর্ণ সহযোগিতা করব। আমাদের উদ্দেশ্য সাধারণ মানুষের কাছ থেকে নেওয়া টাকা ফেরত দেওয়া। লগ্নিকারীদের টাকা আমরা নিয়মিত ফেরত দিয়েও চলেছি।” রোজ ভ্যালির গয়নার শো-রুম ও পর্যটন সংস্থার কাগজপত্রও ইডি-র অফিসারেরা খুঁটিয়ে দেখেছেন বলে এ দিন জানিয়েছেন গৌতমবাবু।
ইডি-সূত্রে বলা হয়েছে, সারদা-মামলায় সুপ্রিম কোর্টে ওড়িশা সরকারের তরফে দাখিল করা হলফনামায় মোট ৪৪টি অর্থলগ্নি সংস্থার নাম রয়েছে। তার মধ্যে সারদা ও রোজ ভ্যালি-সহ পশ্চিমবঙ্গে নথিভুক্ত ১৬টি অর্থলগ্নি সংস্থাও আছে। ওড়িশা সরকারের হলফনামায় অভিযোগ: ওই সব (৪৪টি) লগ্নিসংস্থা সাধারণ মানুষের পাঁচশো কোটি টাকা লুঠ করেছে। সংস্থাগুলির বিরুদ্ধে সিআইডি এবং ওড়িশার বিভিন্ন জেলা পুলিশের কাছে ২০১২, ২০১৩ ও ২০১৪ (২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত)-য় দায়ের হয়েছে বেশ কয়েকটি মামলা। ওড়িশা সিআইডি-র আর্থিক অপরাধদমন শাখা কিছু অভিযোগের তদন্ত শুরু করলেও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলির ব্যবসার জাল অন্য রাজ্যে ছড়ানো থাকায় সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে বলে হলফনামায় জানানো হয়।
এবং সারদা-মামলায় ৯ মে সর্বোচ্চ আদালতের দেওয়া চূড়ান্ত রায়ে ওড়িশা সরকারের ওই হলফনামায় উল্লিখিত প্রতিটি সংস্থার বিরুদ্ধেই সিবিআই-কে তদন্তে নামার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ-সহ বিভিন্ন রাজ্যে বিভিন্ন অর্থলগ্নি সংস্থা দীর্ঘ দিন ধরে লোক ঠকানোর কারবার চালিয়ে গেলেও ইডি, সেবি, এসএফআইও বা রিজার্ভ ব্যাঙ্ক সে ভাবে নড়েচড়ে বসেনি কেন, সুপ্রিম কোর্ট সে প্রশ্নও তোলে। সারদা-তদন্তের অঙ্গ হিসেবে ওই সব নজরদার এজেন্সিগুলির ভূমিকাও খতিয়ে দেখতে সিবিআই-কে নির্দেশ দিয়েছেন বিচারপতিরা। ইডি-র এক সূত্রের দাবি: শীর্ষ আদালতের এ হেন পর্যবেক্ষণের পরে ইডি-র পক্ষে আর চুপ করে বসে থাকা সম্ভব ছিল না। তাই দেরিতে হলেও তারা আটঘাট বেঁধেই এ দিন ‘রোজ ভ্যালি অভিযানে’ নেমেছে।
এ দিকে এ দিন কলকাতায় রোজ ভ্যালি অফিসে ইডি-তল্লাশির সংবাদ ছড়িয়ে পড়তেই সংস্থার কর্মীদের মধ্যে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। রাজ্যের বিভিন্ন জেলায়, এমনকী ত্রিপুরাতেও রোজ ভ্যালির শাখায় শাখায় ঝাঁপ পড়ে যায় সাত তাড়াতাড়ি।