রাজ্যের চাপ, লোকসান সয়েও তাই চটকল চালু

চাহিদা না-থাকলে উৎপাদন অর্থহীন। অর্থনীতির এই বুনিয়াদি নিয়মের বিরুদ্ধে যাওয়া মানে শিল্পের ক্ষতি ডেকে আনা। আর সেই নিয়মের পথে চলতে গিয়েই নর্থব্রুক জুটমিলের মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে গিয়েছে বলে আক্ষেপ শোনা যাচ্ছে চটকল-মালিকদের একাংশের মুখে। ওঁরা বলছেন, শেষ তিন মাসে সরকারি বরাত তেমন ছিল না। ফলে রাজ্যের প্রায় সমস্ত চটকলে লোকসান বাড়ছিল লাফিয়ে লাফিয়ে। সামলাতে না-পেরে মার্চ-এপ্রিলে ৮টি চটকল বন্ধও হয়ে যায়।

Advertisement

জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৭ জুন ২০১৪ ০৩:২৫
Share:

চাহিদা না-থাকলে উৎপাদন অর্থহীন। অর্থনীতির এই বুনিয়াদি নিয়মের বিরুদ্ধে যাওয়া মানে শিল্পের ক্ষতি ডেকে আনা। আর সেই নিয়মের পথে চলতে গিয়েই নর্থব্রুক জুটমিলের মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে গিয়েছে বলে আক্ষেপ শোনা যাচ্ছে চটকল-মালিকদের একাংশের মুখে।

Advertisement

ওঁরা বলছেন, শেষ তিন মাসে সরকারি বরাত তেমন ছিল না। ফলে রাজ্যের প্রায় সমস্ত চটকলে লোকসান বাড়ছিল লাফিয়ে লাফিয়ে। সামলাতে না-পেরে মার্চ-এপ্রিলে ৮টি চটকল বন্ধও হয়ে যায়। কিন্তু রাজ্য সরকার চায়নি, লোকসভা নির্বাচনের মুখে চটকল বন্ধ থাকুক। তাই শ্রম দফতরের মধ্যস্থতায় ভোটের আগে সেগুলোর দরজা ফের খুলতে বাধ্য হন মালিকেরা। এবং সেই ইস্তক বরাত না-জুটলেও স্রেফ সরকারি নির্দেশের সুবাদেই যে রাজ্যের ৬৫টি চটকলে উৎপাদন চালু রাখা হয়েছিল, রাজ্য সরকারের শ্রম দফতরও তা স্বীকার করছে।

তবে মালিকেরা তখন জানিয়ে দিয়েছিলেন, ভোটের পরে উৎপাদন কমানো ছাড়া উপায় নেই। সেটা করতে গিয়েই নর্থব্রুকের সিইও খুন হয়ে গেলেন। যার পরে রীতিমতো আতঙ্কে রয়েছেন রাজ্যের চটশিল্পের কর্ণধারেরা। পরবর্তী পদক্ষেপ স্থির করতে তাঁদের সংগঠন ইন্ডিয়ান জুটমিল অ্যাসোসিয়েশনস (আইজেএমএ) সোমবার সন্ধ্যায় বৈঠকে বসে। সামগ্রিক পরিস্থিতি জানিয়ে কেন্দ্রীয় বস্ত্র মন্ত্রকে এ দিনই বিস্তারিত রিপোর্ট জমা দিয়েছেন রাজ্যের জুট কমিশনার। ২১ জুন তিনিও চটকল-মালিকদের নিয়ে বৈঠকে বসবেন।

Advertisement

বস্ত্র মন্ত্রকের খবর: চটকলগুলো বেঁচে রয়েছে মূলত কেন্দ্রীয় সরকারি বরাতের উপরে ভর করে। খাদ্যশস্য মজুত করার জন্য দিল্লি ফি বছর চটের বস্তা কেনে। চাহিদা অনুযায়ী তারা ঠিক করে, কোন রাজ্যে কত বস্তা লাগবে। সেই হিসেব কলকাতার জুট কমিশনারকে পাঠানো হয়। তার ভিত্তিতে জুট কমিশনারের অফিস প্রতি মাসে বিভিন্ন চটকলকে বস্তার বরাত দেয়। পরিভাষায় একে বলে প্রডাকশন কন্ট্রোল অর্ডার (পিসিও)। চাহিদা না-থাকায় এপ্রিল-মে মাসে যার বহর তলানিতে এসে ঠেকেছিল। কী রকম?

জুট কমিশনার সুব্রত গুপ্ত জানাচ্ছেন, পশ্চিমবঙ্গের চটকলগুলোয় মাসে তিন লক্ষ বেল চটের ব্যাগ তৈরি হতে পারে। সে জায়গায় এপ্রিল-মে দু’মাসে বরাত মিলেছে সাকুল্যে ১ লক্ষ ৫৭ হাজার বেলের। এপ্রিলে তো এসেছে মাত্র দশ হাজার বেলের অর্ডার। “সারা বছরের চটের ব্যাগ কেনার যে কোটা ঠিক হয়েছিল, জুটমিলের স্বার্থেই অগ্রিম বরাত দিয়ে ফ্রেব্রুয়ারির মধ্যে তা প্রায় শেষ হয়ে গিয়েছে। তাই নতুন করে বাড়তি অর্ডার দেওয়ার সুযোগ ছিল না।” ব্যাখ্যা কমিশনারের।

কিন্তু বাড়তি বরাত না-পেলেও গত তিন মাসে ধরে প্রায় সব মিলেই উৎপাদন চালু রাখতে হয়েছে। আইজেএমএ-র সভাপতি রাঘবেন্দ্র গুপ্তের আক্ষেপ, “ভোটের সময় উৎপাদন চালু রাখতে গিয়ে বিভিন্ন মিলে ৮৫ হাজার বেল চটের ব্যাগ মজুত হয়ে গিয়েছে। অথচ উৎপাদন কমাতে গেলে আইন-শৃঙ্খলার অবনতি হচ্ছে!” নর্থব্রুকের মালিক প্রকাশ চুরারিয়ার দাবি: ভোটের সময় মিল চালু রাখার দরুণ তাঁদের প্রায় ৪০ কোটি টাকার চটের ব্যাগ জমে গিয়েছে। দশ হাজার বেলের গুদামে ঠেসেঠুসে রাখা রয়েছে ১১ হাজার। এ দিকে তিন মাস ধরে বাড়তি বরাত না-থাকায় ‘স্টক’ খালাস করা যায়নি। অগত্যা তিনি উৎপাদন কমাতে গিয়েছিলেন। তা নিয়ে গোলমালের জেরেই প্রাণ গেল মিলের সিইও’র।

আইজেএমএ-র চেয়ারম্যান জানাচ্ছেন, লোকসানের চাপে মার্চ-এপ্রিলে ৮টি চটকল বন্ধ করে দিয়েছিলেন মালিকরা। কিন্তু শ্রম দফতর তাঁদের বলে, লোকসভা নির্বাচনের আগে মিল খোলা রাখতে হবে। পারিপার্শ্বিক অবস্থার নিরিখে ওই মালিকেরা লোকসান সয়েই মিল চালাতে বাধ্য হয়েছিলেন। তা দেখে অন্যরাও আর উৎপাদন সাময়িক বন্ধ রাখার পথে হাঁটেননি। কেউ কেউ অবশ্য উৎপাদনে কিছুটা রাশ টেনেছিলেন। কিন্তু লোকসান হচ্ছে জেনেও সরকার কেন তখন চটকল বন্ধ রাখতে চায়নি?

রাজ্যের শ্রমমন্ত্রী পূর্ণেন্দু বসুর বক্তব্য: ভোটের আগে কোনও চটকল বন্ধ হয়ে যাক, সেটা কোনও সরকারের কাম্য হতে পারে না। তাই মালিকদের অনুরোধ করা হয়েছিল, বরাত না-মিললেও তাঁরা যেন উৎপাদন চালিয়ে যান। তবে ভোটের পরে যাতে উৎপাদন কিছুটা কমানো যায়, সে ব্যাপারে দু’পক্ষে একটা বোঝাপড়া হয়েছিল। যার ভিত্তিতে অন্তত ৪০টি চটকলে উৎপাদন হ্রাসের প্রক্রিয়া চলছিল বলে মন্ত্রীর কাছে খবর আছে। “নর্থব্রুকেও সেই প্রক্রিয়া চলছিল। উৎপাদন কমানোর সময়ে সমস্যা হলে মধ্যস্থতা করার জন্য সরকার রয়েছে। কিন্তু যারা আইন হাতে তুলে নিয়ে খুন করেছে, তাদের ছাড়া হবে না।” এ দিন আশ্বাস দিয়েছেন পূর্ণেন্দুবাবু। পাশাপাশি প্রশ্নও তুলেছেন, “কেন্দ্রীয় সরকার বরাত না-দিলে চটকল চলবে কী ভাবে?” চটশিল্পের সঙ্গে জড়িত মহলের একাংশ অবশ্য গোটা ঘটনার পিছনে সরকারের ‘ভোটমুখী’ মানসিকতারও ছায়া দেখছে। এই মহলের যুক্তি: চটকল বন্ধ বা উৎপাদন ছাঁটাই হলে শ্রমিকদের (যাঁদের অধিকাংশ ভিন রাজ্যের বাসিন্দা) অনেকে ‘দেশে’ চলে যান। ভোটের আগে এমনটা হলে ব্যারাকপুর ও হুগলি শিল্পাঞ্চলের কয়েক লক্ষ শ্রমিকের পেটে টান পড়তো ঠিকই। উপরন্তু তাঁরা ‘দেশে’ চলে গেলে ভোটও দিতে পারতেন না। সরকারি ‘অনুরোধের’ নেপথ্যে এই বিষয়টিরও ভূমিকা রয়েছে বলে চটশিল্প মহলের সংশ্লিষ্ট অংশের অভিমত।

সাম্প্রতিক পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে চটকল-মালিকেরা আরও দুশ্চিন্তায় পড়েছেন। রাঘবেন্দ্রবাবুর দাবি: রাজ্য সরকারও পাটজাত সামগ্রীর বাজার তৈরিতে এগিয়ে আসুক। কেন্দ্রেরও উচিত আরও বেশি পাটজাত জিনিস কেনা। জুট কমিশনার জানান, তেমন প্রয়োজন না-থাকলেও চটশিল্পের স্বার্থে জুন মাসে ১ লক্ষ বেল ব্যাগের বরাত দেওয়া হয়েছে। চেষ্টা চলছে আরও ১ লক্ষ বেলের বরাত দেওয়ার।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন