মতুয়া মহল

রেশন কার্ড থেকেও অস্বস্তি, মোদী-নজরে তাঁরাই

নরেন্দ্র মোদী মতুয়াদের নাগরিকত্ব নিয়ে সরব হওয়ার পরে ৪৮ ঘণ্টা কেটে গিয়েছে। মতুয়া সম্প্রদায়ের নাগরিকত্ব নিয়ে ‘সঙ্কট’-এর চেহারাটা আদৌ কী ধরনের, তা নিয়ে চাপানউতোর থামেনি। ও-পার বাংলা থেকে আসা মতুয়াদের মধ্যে অনেকের দাবি, তাঁরা ভোটের পরিচয়পত্র, রেশন-কার্ড পেয়ে গিয়েছেন।

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ১০ মে ২০১৪ ০৩:৫৩
Share:

নরেন্দ্র মোদী মতুয়াদের নাগরিকত্ব নিয়ে সরব হওয়ার পরে ৪৮ ঘণ্টা কেটে গিয়েছে। মতুয়া সম্প্রদায়ের নাগরিকত্ব নিয়ে ‘সঙ্কট’-এর চেহারাটা আদৌ কী ধরনের, তা নিয়ে চাপানউতোর থামেনি।

Advertisement

ও-পার বাংলা থেকে আসা মতুয়াদের মধ্যে অনেকের দাবি, তাঁরা ভোটের পরিচয়পত্র, রেশন-কার্ড পেয়ে গিয়েছেন। আবার আর একটি অংশ জানাচ্ছেন, তাঁরা এখনও ভারতের পূর্ণ নাগরিক নন। তবে শ্রীরামপুরে মোদী যে ভাবে বলেছিলেন ’৪৭-এর পরে এই রাজ্যে যাঁরা এসেছেন, তাঁরা বিছানা গুছিয়ে রাখুন। ১৬ মে-র পরে তাঁদের সবাইকে দেশে ফিরে যেতে হবে তাতে ওই মতুয়ারা রীতিমতো ঘাবড়ে যান। কিন্তু এ বারে মোদী এসে মতুয়ারা ‘ভারত মায়ের সন্তান, যাঁরা মায়ের কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে থাকতে চান’ বলায় তাঁরা আপাতত কিছুটা স্বস্তি বোধ করছেন।

বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, নাগরিকত্বের প্রমাণে কোনও রকমে ভোটার কার্ড বা রেশন কার্ড জোগাড় করাটাই শেষ কথা নয়। ১৯৭১ সালের পরে যাঁরা এ দেশে এসেছেন, তাঁদের কেউ কেউ টাকা দিয়ে, কেউ বা রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় রেশন কার্ড পেয়েছেন বা ভোটার কার্ড জোগাড় করে ফেলেছেন। কেউ রেশন কার্ড পেয়েছেন, ভোটার কার্ড পাননি। কারও ভোটার কার্ড হয়েছে, ভোটার তালিকায় নাম ওঠেনি। কারও বা পরিবারের সকলের হাতে কার্ড পৌঁছয়নি। অনেকে রেশন কার্ড, ভোটার কার্ড নিয়েও এ দেশের স্কুলের অ্যডমিট কার্ড না থাকায় কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে গিয়ে সমস্যায় পড়ছেন। কারও পাসপোর্ট তৈরিতে বা সম্পত্তি কিনতে অসুবিধা হচ্ছে। সমস্যা তৈরি হয় সরকারি চাকরির ক্ষেত্রেও। যেখানে প্রার্থীর অতীত নিয়ে পুলিশি অনুসন্ধানের প্রয়োজন থাকে। অর্থাৎ পূর্ণ এবং বৈধ নাগরিকত্বের দরকারটা থেকেই গিয়েছে।

Advertisement

গবেষকেরা জানাচ্ছেন, এমন অবৈধ বসবাসকারীদের নাগরিকত্ব দেওয়ার একটাই আইনি পথ আছে। রাজনৈতিক, ধর্মের কারণে অত্যাচারিত হয়ে শরণার্থী হলে তাদের নাগরিকত্ব দেওয়া যায়। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে রাজস্থান এবং গুজরাত এই দুই রাজ্য পাকিস্তান থেকে আসা উদ্বাস্তুদের নাগরিক করেছে।

রাজনীতির পর্যবেক্ষকদের মতে, মতুয়াদের নাগরিকত্বের জন্য এই উপায়টির দিকেই ইঙ্গিত করেছেন মোদী। বাংলাদেশে যাঁরা ধর্মীয় সংখ্যালঘু, তাঁরাই এ ভাবে ‘শরণার্থী’ হওয়ার যোগ্যতা পেতে পারেন। সে ক্ষেত্রে রাজ্য সরকারকে এই ধরনের ‘শরণার্থীদের’ নাগরিকত্ব দেওয়ার প্রস্তাব কেন্দ্রীয় সরকারকে পাঠাতে হবে। পর্যবেক্ষকদের মতে, মতুয়াদের মধ্যে যে অংশটির নাগরিকত্ব নিয়ে ‘অনিশ্চয়তা’ রয়েছে, মোদী তাদের কথাই বলতে চেয়েছেন। এর মাধ্যমে এই হিন্দু ভোট-ব্যাঙ্ককে কাছে টানার বার্তাটি সুকৌশলে দিয়ে গিয়েছেন এবং সেই সুবাদে বিঁধেছেন এ রাজ্যে ক্ষমতাসীন তৃণমূল সরকারকে।

বাংলাদেশে (পূর্ব পাকিস্তানে) পথ চলা শুরু মতুয়া ধর্ম সম্প্রদায়ের। অন্যতম সঙ্ঘাধিপতি প্রমথরঞ্জন ঠাকুর ১৯৪৭ সালে এ দেশে এসে, পরের বছর গাইঘাটার ঠাকুরনগরে ঠাকুরবাড়ি প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর সময়েও যেমন মতুয়ারা এ দেশে এসেছেন, অনেকে এসেছেন ’৭১-র যুদ্ধের পরে, ’৭৫-এ মুজিব হত্যার পরে। এমনকী, এ রাজ্যের সীমান্ত-লাগোয়া এলাকায় তারও পরে আসা মতুয়ার খোঁজ মিলতে পারে বলে জানাচ্ছেন বিদেশ মন্ত্রকের ‘সেন্টার ফর ইন্দো-বাংলাদেশ রিলেশনস’-এর প্রাক্তন কর্তা বিমল প্রামাণিক। কেন্দ্রীয় প্রকল্পে শরণার্থী-অনুপ্রবেশকারীদের দৌলতে এ রাজ্যের জনবিন্যাসের পরিবর্তন নিয়ে কাজ করতে গিয়ে দুই ২৪ পরগনা, নদিয়া, মুর্শিদাবাদ, মালদহের মতো একাধিক জেলায় ভিন্ দেশ থেকে আসা জনতার অস্তিত্বের প্রমাণ পেয়েছিলেন বিমলবাবু। উত্তর ২৪ পরগনার বনগাঁ, বারাসত, বসিরহাট, দক্ষিণ ২৪ পরগনার ডায়মন্ড হারবার, নদিয়ার কৃষ্ণনগর এবং রানাঘাট মহকুমায় ১৯৫১ থেকে এ পর্যন্ত সেই অনুপ্রবেশকারীদের সংখ্যা ক্রমশ বেড়েছে বলেই তাঁর অনুমান।

রাজ্যে এখন মতুয়া ধর্মাবলম্বীর সংখ্যা প্রায় এক কোটি। গবেষকদের হিসেবে তাঁদের উপস্থিতি বেশি নজরে পড়ে রাজ্যের ৭৪টি বিধানসভা এলাকায়। যে সব আসনে এখনও ভোট বাকি তাদের মধ্যে কৃষ্ণনগর, রানাঘাট, বনগাঁ, বারাসত, দমদম, যাদবপুর, ডায়মন্ড হারবার, মথুরাপুর অন্যতম মতুয়া প্রভাবিত কেন্দ্র। বুধবার কৃষ্ণনগর ও বারাসতের দু’টি সমাবেশেই মতুয়া নাগরিকত্ব প্রসঙ্গ তোলেন মোদী। এই আবহেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পাল্টা দাবি করেন, মতুয়ারা দীর্ঘদিন ভারতের নাগরিক। ব্যাপারটা না জেনে মন্তব্য করেছেন মোদী।

তাই কি?

বনগাঁ লোকসভা আসনে বিজেপি প্রার্থী কেডি বিশ্বাস কিন্তু বলছেন, গোটা রাজ্যে অন্তত ২০ লক্ষ মতুয়া এখনও ভারতের নাগরিকত্ব পাননি। মোদী এঁদের কথাই বলেছেন। মতুয়া মহাসঙ্ঘের প্রাক্তন কর্তা কেডি জানাচ্ছেন, ২০১০-এর ডিসেম্বরে ধর্মতলায় সমাবেশ করে ২০০৩-এর ‘সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট’ প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছিলেন মতুয়ারা। ২০১২-র ১১ মার্চ ধর্মগুরু হরিচাঁদ ঠাকুরের জন্মের দ্বিশতবর্ষপূর্তি উপলক্ষে অনুষ্ঠানেও দাবি ওঠে, ‘চাই নাগরিকত্ব, চাই জাতিপত্র’। কেডি-র কটাক্ষ, “তা হলে মোদী এখন সেই সমস্যা মেটানোর আশ্বাস দেওয়ায় লোকজন চটছেন কেন?”

এর উত্তরে সারা ভারত মতুয়া মহাসঙ্ঘের সঙ্ঘাধিপতি তথা বনগাঁর তৃণমূল প্রার্থী কপিলকৃষ্ণ ঠাকুরের জবাব, “মোদী কথাটা মন থেকে বলছেন না। কালা কানুন তো ওঁদের সরকারই করেছে।” অন্য দিকে বাম নেতা কান্তি বিশ্বাসের (যিনি নিজেও মতুয়া) টিপ্পনী, “২০০৩-এর আইন বাতিল না করে কী করে মতুয়াদের নাগরিকত্ব দেবেন মোদী?”

২০০৩ সালে বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ সরকারই ‘সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট’ আনে। এই আইনের যে নির্যাস কপিল শিবির করছে, তা হল ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পরে ভিন্দেশ থেকে আগতদের আর ভারতীয় নাগরিকত্ব পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। কারণ, অবৈধ ভাবে এ দেশে ঢোকা উদ্বাস্তুদের সন্তানকেও রাষ্ট্র অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হিসেবেই দেখবে। সেই সুতো ধরে কপিলের সওয়াল, যে বিজেপি-র জন্য ওই সময়ের পরে এ দেশে আসা মতুয়াদের অস্তিত্ব প্রশ্নের মুখে, সেই বিজেপি-র প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী কোন মুখে নাগরিকত্ব দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন? পক্ষান্তরে বামেদের কটাক্ষ, এনডিএ সরকারের আমলের ওই আইন সমর্থন করেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও।

মতুয়া সম্প্রদায়কে কেন্দ্র করে রাজনীতি অবশ্য আজ থেকে হচ্ছে না। স্বাধীনতার পরে মতুয়াদের যে অংশ এ দেশে আসেন, তৎকালীন কংগ্রেস সরকার তাঁদের ভারতের বিভিন্ন জায়গায় পুনর্বাসন দেয়। পশ্চিমবঙ্গ ছাড়া, আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ, অবিভক্ত মধ্যপ্রদেশ ও মহারাষ্ট্রে। প্রবীণ মতুয়াদের একাংশের বক্তব্য, পুনর্বাসন নিয়ে মতুয়াদের ক্ষোভ ছিল। এ রাজ্যে ক্ষমতায় এসে সেই ক্ষোভকেই কাজে লাগায় বামফ্রন্ট সরকার। তিন দশকের বাম আমলে রেশন কার্ড বিলির মাধ্যমে মতুয়াদের একটা বড় অংশের ভোটকে বামফ্রন্ট নিজের দখলে আনে। তবে মতুয়া জাতিসত্তার বিষয়টি নিয়ে বামেরা তেমন সরব হননি বলে অভিযোগ ছিল মতুয়া মহলের। মতুয়া জাতিসত্তার রাজনীতি নিয়ে গবেষণারত প্রস্কণ্ব সিংহরায়ের মতে, রাজ্যে বাম জমানা অবসানের পরে হিন্দুধর্মের পরিসরের বাইরে মতুয়া মহাসঙ্ঘের একটি স্বতন্ত্র রাজনীতির সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল। প্রচুর প্রতিশ্রুতি দিয়ে তৃণমূল তাকে কাজে লাগায়। সামাজিক অপ্রাপ্তির বিষয়টিকে উস্কে এবং স্থানীয় উন্নয়নের সূত্র ধরে তাঁদের মধ্যে প্রভাব বিস্তার করে তৃণমূল। মতুয়া মহলে তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে ছিলেন উত্তর ২৪ পরগনার জেলা তৃণমূল পর্যবেক্ষক জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক। ২০১১-তে তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পরে জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকই খাদ্যমন্ত্রী হন। ত্রাণ ও পুনর্বাসনমন্ত্রী হন ঠাকুরবাড়ির বংশধর মঞ্জুলকৃষ্ণ ঠাকুর। এ বার বনগাঁয় তৃণমূলের প্রার্থী মঞ্জুলেরই দাদা কপিলকৃষ্ণ। এখন বিজেপি আবার মতুয়াদের হিন্দুত্বের রাজনীতির মূলস্রোতে আনতে চাইছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন