রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে অফিস করতেন সারদার কর্মচারী, বিস্মিত ইডি

সুদীপ্ত সেন বার বার দাবি করেছেন, সংবাদমাধ্যমের ব্যবসায় বিপুল পরিমাণ টাকা ঢেলে লোকসান হওয়াতেই তাঁর অর্থলগ্নি ব্যবসার ভরাডুবি হয়েছে। এই সূত্র ধরে তদন্তে নেমে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি) জেনেছে, একাধিক দৈনিক ও পাক্ষিক পত্রিকা এবং টেলিভিশন চ্যানেল-সহ প্রায় ১৫টি সংবাদমাধ্যম নিজেদের দখলে রাখতে সুদীপ্ত সেনের সারদা গোষ্ঠী চার বছরে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছিল।

Advertisement

শুভাশিস ঘটক

শেষ আপডেট: ১২ জুন ২০১৪ ০২:৪৮
Share:

সুদীপ্ত সেন বার বার দাবি করেছেন, সংবাদমাধ্যমের ব্যবসায় বিপুল পরিমাণ টাকা ঢেলে লোকসান হওয়াতেই তাঁর অর্থলগ্নি ব্যবসার ভরাডুবি হয়েছে। এই সূত্র ধরে তদন্তে নেমে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি) জেনেছে, একাধিক দৈনিক ও পাক্ষিক পত্রিকা এবং টেলিভিশন চ্যানেল-সহ প্রায় ১৫টি সংবাদমাধ্যম নিজেদের দখলে রাখতে সুদীপ্ত সেনের সারদা গোষ্ঠী চার বছরে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছিল। দক্ষিণ কলকাতার গোলপার্কের একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে থাকা সারদার ১৫টি অ্যাকাউন্ট থেকেই সংবাদমাধ্যম-সংক্রান্ত ব্যবসার যাবতীয় অর্থ লেনদেন হত। তদন্তকারীরা জেনেছেন, টাকা জমা রাখা নয়, লেনদেনের জন্যই অ্যাকাউন্টগুলি ব্যবহার করা হত।

Advertisement

কী ভাবে?

ইডি জানিয়েছে, টাকা না থাকলেও ওই সব অ্যাকাউন্ট থেকে প্রায় নিয়মিত চেক ‘ইস্যু’ করা হত। সেই চেক ভাঙানোর (ক্লিয়ারিং)-র জন্য ব্যাঙ্কের সংশ্লিষ্ট বিভাগে জমাও পড়ত। ক্লিয়ারিং বিভাগে চেক জমা পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই ব্যাঙ্কের ‘সোর্স’-এর মাধ্যমে সেই খবর পেয়ে যেতেন সারদা কর্তারা। তখন তাঁরা একটি বেসরকারি ব্যাঙ্কে থাকা নিজেদের অ্যাকাউন্ট থেকে সেই পরিমাণ অর্থ অনলাইনে পাঠিয়ে দিতেন সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্টে। ফলে সহজেই চেক ক্লিয়ার হয়ে যেত। ইডি-র দাবি, গোটা পদ্ধতিটা সুষ্ঠু ভাবে সম্পন্ন করার জন্য সারদা গোষ্ঠীর এক হিসাবরক্ষক ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষের একাংশের সঙ্গে সমন্বয় রেখে চলতেন। দু’পক্ষের সম্পর্ক ও বোঝাপড়া এমন পর্যায়ের ছিল যে, সারদার ওই হিসাবরক্ষকের বসার জন্য গোলপার্কের ওই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে আলাদা ঘরের ব্যবস্থাও ছিল।

Advertisement

তদন্তে ইডি জেনেছে, সারদার বিভিন্ন সংস্থায় লক্ষাধিক টাকা বেতনের কর্মী থাকলেও হুগলির বাসিন্দা, মাসিক দশ হাজার টাকা বেতনের ওই হিসাবরক্ষকের উপর অগাধ আস্থা ছিল সুদীপ্ত সেনের। এক তদন্তকারী জানান, ঘটনা জেনে তাঁরা রীতিমতো বিস্মিত। সকাল সকাল হুগলির আরামবাগের বাড়ি থেকে কোম্পানির দেওয়া গাড়িতে চড়ে গোলপার্কের ওই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে গিয়ে হাজির হতেন ওই কর্মচারী। সারদা সংস্থার হিসাবরক্ষক হলেও তিনি ওই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের গোলপার্ক শাখায় তাঁর জন্য নির্দিষ্ট একটি ঘরে বসতেন। সকাল থেকে সন্ধ্যা ব্যাঙ্কেই থাকতেন। সন্ধ্যায় সারদার গাড়িতে বাড়ি ফিরে যেতেন।

তদন্তকারীরা জেনেছেন, সারদার ওই হিসাবরক্ষক ব্যাঙ্কে পৌঁছে যেতেন সকাল ৯টার মধ্যে। তার পর ওই ব্যাঙ্কে থাকা সারদার বিভিন্ন অ্যাকাউন্ট থেকে সংবাদমাধ্যমের ব্যবসার জন্য ওই দিন মোট কত টাকার চেক জমা পড়েছে, তা ফোন করে সুদীপ্ত সেন অথবা দেবযানী মুখোপাধ্যায়কে জানাতেন। সেটা জেনে সুদীপ্ত বা দেবযানী সমপরিমাণ অর্থ অনলাইনে অ্যাকাউন্টে পাঠানোর ব্যবস্থা করতেন।

এই ব্যাপারে হুগলির বাসিন্দা ওই হিসাবরক্ষককে ইতিমধ্যেই কয়েক দফায় জিজ্ঞাসাবাদ করেছে ইডি। তাদের এবং বিধাননগর কমিশনারেটের গোয়েন্দাদের জেরার মুখে সারদার কর্ণধার সুদীপ্ত সেন একাধিক বার জানিয়েছেন, মূলত সংবাদমাধ্যমের ব্যবসায় বিপুল লোকসানের কারণেই তাঁর অর্থলগ্নির কারবার ডুবে গিয়েছে। কিন্তু আমানতকারীদের ওই তিনশো কোটি টাকার সবটা সত্যি সত্যিই সংবাদমাধ্যমের ব্যবসায় ঢালা হয়েছিল, নাকি অন্য কোথাও, অন্য কারও কাছে চলে গিয়েছিল তা জানার জন্য সুদীপ্ত সেন ও দেবযানী মুখোপাধ্যায়কে ফের জেরা করার কথা ভাবছেন তদন্তকারীরা। সেই সঙ্গে গোলপার্কের ওই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের লেনদেনের হিসেবও পুঙ্খানুপুঙ্খ খতিয়ে দেখা প্রয়োজন বলে গোয়েন্দারা মনে করছেন। প্রয়োজনে ওই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের কয়েক জন কর্তার সঙ্গেও কথা বলবেন তাঁরা।

এক তদন্তকারী জানান, ২০০৯-এর জুন থেকে ২০১৩-র এপ্রিল পর্যন্ত সংবাদমাধ্যমের ব্যবসায় মোট প্রায় ৩০০ কোটি টাকা খরচ করেছিল সারদা গোষ্ঠী। ইডি-র বক্তব্য, বছরে সাধারণত ২৬১ দিন ব্যাঙ্ক খোলা থাকে। সেই হিসেবে ২০০৯-এর জুন মাস থেকে ২০১৩-র এপ্রিল পর্যন্ত ৩০০ কোটি টাকা খরচ হয়ে থাকলে এই সময়ের মধ্যে রোজ গড়ে ২৫ লক্ষ টাকা সংবাদমাধ্যমের ব্যবসায় উপুড়হস্ত করেছে সারদা গোষ্ঠী। কিন্তু সংবাদমাধ্যমের ব্যবসায় সারদা গোষ্ঠীর প্রথম প্রয়াস ২০১০ সালের মাঝামাঝি একটি বাংলা ও একটি ইংরেজি দৈনিক প্রকাশের মাধ্যমে। সে ক্ষেত্রে ২০০৯-এর জুন থেকে যে বিপুল খরচ করা হয়েছে, তা সংবাদমাধ্যমের ব্যবসার প্রস্তুতি খাতে না অন্য কোনও কারণে, সেটা তদন্তকারীরা খতিয়ে দেখছেন।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement