লেক মলে পুরনোরা ব্রাত্য, সুবিধা নতুনদেরই

সাবেক লেক মার্কেট ভেঙে যে নতুন লেক মল তৈরি হয়েছে, সেখানে মূলত দু’ধরনের ব্যবসায়ী দোকান পেয়েছেন। এক দল, যাঁরা লেক মার্কেটের সাবেক ব্যবসায়ী। অন্য দল, যাঁদের বসিয়েছে লেক মলের নির্মাণ সংস্থা ভেঙ্কটেশ। সাবেক ব্যবসায়ীদের যেখানে বর্গফুট পিছু চার থেকে ছয় টাকা পর্যন্ত ভাড়া দিতে হয় পুরসভাকে, সেখানে নতুন ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে পুরসভা পায় বর্গফুট পিছু এক টাকা ৬৩ পয়সা!

Advertisement

অনুপ চট্টোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ০১ অক্টোবর ২০১৪ ০৩:৩৩
Share:

সাবেক লেক মার্কেট ভেঙে যে নতুন লেক মল তৈরি হয়েছে, সেখানে মূলত দু’ধরনের ব্যবসায়ী দোকান পেয়েছেন। এক দল, যাঁরা লেক মার্কেটের সাবেক ব্যবসায়ী। অন্য দল, যাঁদের বসিয়েছে লেক মলের নির্মাণ সংস্থা ভেঙ্কটেশ। সাবেক ব্যবসায়ীদের যেখানে বর্গফুট পিছু চার থেকে ছয় টাকা পর্যন্ত ভাড়া দিতে হয় পুরসভাকে, সেখানে নতুন ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে পুরসভা পায় বর্গফুট পিছু এক টাকা ৬৩ পয়সা! ভাড়ায় এই বিপুল বৈষম্যের বিষয়টি নিয়ে রীতিমতো ক্ষুব্ধ অধিকাংশ পুরনো ব্যবসায়ী। তাঁদের বক্তব্য, পুরনো ব্যবসায়ীদের স্বার্থে লেক মার্কেট পুনর্গঠনের কথা কাগজে-কলমে বলা হলেও আদপে তার সুবিধা পাচ্ছেন কম ভাড়ায় থাকা ওই নতুন দোকানগুলি। পুরনো ব্যবসায়ীদের শুধু যে বেশি ভাড়া দিতে হয়, তা-ই নয়। তাঁরা নতুনদের তুলনায় যথেষ্ট পরিষেবাও পান না বলে অভিযোগ। পুরনো ব্যবসায়ীদের বক্তব্য, মলের নির্মাণ সংস্থা ভেঙ্কটেশকে বিশেষ সুবিধা দিতেই ব্যস্ত পুরসভা।

Advertisement

সাবেক ব্যবসায়ীদের অভিযোগের যথার্থতা মিলল মলে ঢুকেই। যে অংশটুকুতে নতুন ব্যবসায়ীদের বসানো হয়েছে, সেটুকু একেবারে ঝাঁ চকচকে। হাঁটতে গিয়ে পা পিছলে পড়ার অবস্থা! সেটা অবশ্য দোতলা থেকে উপরের দিকের অংশে। ঠিক তার উল্টো চিত্র একতলায়। যেখানে লেক মার্কেটের পুরনো প্রায় ৪৫০ দোকানকে কোনও ভাবে ঠাঁই দেওয়া হয়েছে! সরু করিডরের দু’পাশে ভর্তি দোকান। আর দোকানের উপচে পড়া মালপত্রের কারণে দু’টো মানুষের পাশাপাশি হাঁটাও সমস্যার। এক পুরনো দোকানদারের কথায়, “এই মার্কেটের উন্নয়নের কথা ভেবে এক সময় কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় পথে নেমেছিলেন। পরবর্তী কালে বাজারের উন্নয়নে পুর প্রশাসন বেসরকারি হাতে তা গড়ার ভার দেয়। মল তৈরি হলো বটে, তবে আমাদের দুর্ভোগ আর কাটল না!”

দুর্ভোগের ছবিটা কেমন?

Advertisement

সাবেক লেক মার্কেটের এক ব্যবসায়ী মহম্মদ ইউনিস জানান, পুরনো ব্যবসায়ীদের যেখানে বসানো হয়েছে, সেখানে বেশ কিছু দোকান খোলাই যায় না। কেন? ব্যবসায়ীদের বক্তব্য, লেক মলের বেসমেন্টে গ্যারাজ তৈরি করেছে নির্মাণ সংস্থা ভেঙ্কটেশ। আর সেটা করতে গিয়ে মার্কেটের বাইরে থাকা ভ্যাটটি ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে এক তলার বেশ কিছু দোকানের পাশে। এর পাশাপাশি আছে শৌচাগারের যন্ত্রণা। নীচে ৪৫০ দোকানের জন্য একই জায়গার মধ্যে তিনটে শৌচাগার! এবং সেটাও আবার ভ্যাটের পাশেই! ফলে দুর্গন্ধে সেখানে কেউ ঢুকতেই পারেন না। উপরের দিকের ছবিটা কিন্তু সম্পূর্ণ অন্য রকম। সেখানে কিন্তু ঝাঁ চকচকে শৌচাগার করে দিয়েছে নির্মাণ সংস্থা।

পুরনো ব্যবসায়ীদের অভিযোগ মেনে নিয়েছেন শাসক দলের অনেক নেতা-কর্মীও। স্থানীয় এক তৃণমূল নেতার কথায়, “ভ্যাটের জন্য পাশেই থাকা বাড়ির ভাড়াটেরা ঘর ছেড়ে পালাচ্ছেন!” ঝাঁ চকচকে মলের একতলার করুণ দশা যে তাঁর দলকেও অস্বস্তিতে ফেলেছে, তা মেনে নিয়েছেন ওই নেতা। তাঁর কথায়, “মলের নির্মাণ সংস্থা যে অংশটুকু থেকে সেলামি পাবে, সেটুকু সাজিয়ে দিয়েছে। কিন্তু পুরনো ব্যবসায়ীদের স্বার্থ দেখা হয়নি।” মহম্মদ ইউনিস জানান, প্রায় এক বছর আগে লেক মলের উদ্বোধন হয়েছে। কিন্তু এখনও গোটা তিরিশেক মাছ ব্যবসায়ীকে মলে জায়গা দেওয়া হয়নি। মাছ বাজারের বাইরে টিনের ছাউনি দিয়ে তাঁদের বসানো হয়েছে। এ বিষয়ে পুরসভার বাজার দফতরের এক অফিসার জানান, লেক মলের বিষয়টি পুরসভার সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ দেখছেন। তাঁদের কিছু করার নেই। ভেঙ্কটেশ-কর্তা শ্রীকান্ত মোহতার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তাঁর ফোন বেজেই গিয়েছে।

পুরসভা সূত্রের খবর, ইতিমধ্যেই ভেঙ্কটেশের হাত ধরে ১৭টি সংস্থা লেক মলে ব্যবসা শুরু করেছে। পুরসভার এক আমলার কথায়, ১৯৮৭ সালের চুক্তিতে বলা ছিল, লেক মার্কেট পুনর্গঠন হলে প্রথমেই পুরনো দোকানগুলোকে পুনর্বাসন দিতে হবে এবং পুরসভার জন্য এক হাজার বর্গমিটার জায়গা দিতে হবে। এর পরে বাকি যে অংশ থাকবে, তা ভাড়া দেওয়া হবে। সে ক্ষেত্রে সেলামি নিয়ে ভাড়াটে খোঁজার ভার পাবে নির্মাণ সংস্থা। কিন্তু সেই ভাড়াটের সঙ্গে আলাদা চুক্তি হবে পুরসভার। পুরসভা ওই সব দোকান থেকে ভাড়া পাবে। কিন্তু লেক মলের ক্ষেত্রে সেই নিয়ম মানা হয়নি বলে জানান ওই আমলা। আরও অভিযোগ, শুধু সেলামি নয়, নির্মাণ সংস্থাটি নতুন দোকানগুলি থেকে বর্গফুট পিছু বেশি ভাড়াও নিচ্ছে। পুরসভার একটি সূত্রের দাবি, ভেঙ্কটেশ যেখানে বর্গফুট পিছু প্রায় ৩০ থেকে ৪০ টাকা ভাড়া নিচ্ছে, সেখানে পুরসভা পাচ্ছে প্রতি বর্গফুটে মাত্র ১ টাকা ৬৩ পয়সা!

অনিয়মের কাহিনি এখানেই শেষ নয়। পুরসভা সূত্রে জানা গিয়েছে, লেক মলের বেসমেন্টে নির্মাণ সংস্থা ভেঙ্কটেশ যে গ্যারাজ তৈরি করেছে, সেখানে চার চাকা গাড়ির জন্য ঘণ্টাপিছু নেওয়া হচ্ছে ২০ টাকা। তিন ঘণ্টার বেশি হলে দিতে হচ্ছে ঘণ্টা প্রতি ৩০ টাকা। আর মোটরবাইকের জন্য ঘণ্টাপিছু ১০ টাকা। পুরসভার এক অফিসার জানান, গত বছর অগস্টেই ওই পার্কিং গ্যারাজ চালু হয়েছে। কিন্তু পুরসভাকে এ বাবদ কোনও ভাড়া এখনও পর্যন্ত দেওয়া হয়নি বলেই পুরসভা সূত্রের খবর। এ বিষয়ে তৃণমূলের একাধিক নেতার বক্তব্য, লেক মল খুব স্পর্শকাতর বিষয়। ৬০ বছরের লিজ চুক্তি দু’ভাগে ভাঙা তো এখন হলো। এর আগেও ওই মলের নির্মাণ সংস্থা ভেঙ্কটেশ ফাউন্ডেশনের সুবিধার্থে নানা ‘অঘটন’ ঘটানো হয়েছে বলে অভিযোগ তাঁদের।

কী ভাবে? একাধিক ব্যবসায়ী এবং তৃণমূল নেতা বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘোষিত নীতি ছিল পুনর্বাসন না দিয়ে হকার উচ্ছেদ করা যাবে না। লেক মলের সামনের রাস্তা খালি করতে তা-ও ভাঙা হয়েছে। এক প্রকার চাপ দিয়েই শ’খানেক দোকানদারকে সরানো হয়েছে।” এক তৃণমূল নেতার কথায়, “নিউ মার্কেটের সামনের রাস্তায় বেআইনি ভাবে বসে থাকা হকারদের কিন্তু এখনও সরাতে পারেনি পুরসভা বা সরকার কেউই। অথচ ভেঙ্কটেশ সংস্থার স্বার্থে লেক মলের সামনে এমনটা করা হয়েছে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন