নয়া মঞ্চের সূচনায় লক্ষ্মণ শেঠ ও তাঁর স্ত্রী তমালিকা। —নিজস্ব চিত্র।
কমিউনিস্ট পার্টির স্বপ্নে এখনও বিপ্লব। অথচ যুগের ধারা মেনেই তাদের চলতে হচ্ছে সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায়। এই দ্বিচারিতার মধ্যে পথ খুঁজে এগোনোর মতো ভাবনাচিন্তা দলের নেতাদের নেই। আর কেন্দ্রীয় থেকে রাজ্য কমিটি, সবই ভর্তি করে ফেলা হয়েছে স্তাবক দিয়ে! এই অবস্থায় সিপিএমে থাকার কোনও যুক্তি খুঁজে পাচ্ছিলেন না তাঁরা। সিপিএম ছেড়ে বেরিয়ে নতুন ‘ভারত নির্মাণ মঞ্চে’র আত্মপ্রকাশ ঘোষণা করতে গিয়ে এমনই তোপ দাগলেন দলের বহিষ্কৃত নেতা লক্ষ্মণ শেঠ। যা শুনে সিপিএমের রাজ্য নেতৃত্বের প্রশ্ন, ১৯৭০ সাল থেকে দলের সদস্য লক্ষ্মণবাবুর এই উপলব্ধিতে পৌঁছতে ৪৪ বছর লাগল কেন!
লক্ষ্মণকে বহিষ্কারের পরে দলীয় তদন্ত প্রক্রিয়া নিয়ে সমস্যা অব্যাহত ছিল পূর্ব মেদিনীপুর জেলা সিপিএমে। দলের রাজ্য নেতৃত্বের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করে সম্প্রতি সিপিএম ছাড়ার ঘোষণা করেছেন লক্ষ্মণ-জায়া তমালিকা পণ্ডা শেঠ, অমিয় সাহু, প্রণব দাস, প্রশান্ত পাত্র, অশোক গুড়িয়া, অশোক বেরা-সহ এক ঝাঁক জেলা নেতা। দলত্যাগী ওই সব নেতা ও তাঁদের অনুগামীদের পূর্ব মেদিনীপুর থেকে নিয়ে এসেই শুক্রবার গোখেল গার্লস কলেজের প্রেক্ষাগৃহে আনুষ্ঠানিক ভাবে ঘোষণা হল লক্ষ্মণদের নতুন মঞ্চের। লক্ষ্মণবাবু জানিয়েছেন, তাঁরা বামপন্থার পথেই থাকবেন। কোনও দলে এখন তাঁরা যোগ দিচ্ছেন না। বিজেপি বা তৃণমূলের খারাপ কাজের যেমন তাঁরা প্রতিবাদ করবেন, তেমনই ভাল কাজকে সমর্থনও করবেন। একই সঙ্গে অবশ্য লক্ষ্মণবাবু বলে রেখেছেন, “সমাজ পরিবর্তনশীল। ভবিষ্যতে পরিস্থিতি বদলালে কোনও দলকে সমর্থনের কথা আমরা ভেবে দেখব।”
গোখেল কলেজের প্রেক্ষাগৃহে লক্ষ্মণ, তমালিকা, অমিয়, প্রশান্তবাবুরা যখন তাঁদের সদ্য ছেড়ে-আসা দলের বিরুদ্ধে মুখর হয়েছেন, সেই সময়েই কয়েক কিলোমিটার দূরে আলিমুদ্দিনে সিপিএমের রাজ্য কমিটির বৈঠকের শেষ দিনে উঠেছে পূর্ব মেদিনীপুরের দলত্যাগীদের প্রসঙ্গ। ভারপ্রাপ্ত জেলা সম্পাদক প্রশান্ত প্রধান রাজ্য কমিটিতে জানিয়েছেন, তদন্ত প্রক্রিয়া চালাতে গিয়ে অনেকের বিরুদ্ধেই তথ্যপ্রমাণ হাতে আসছে। সে সবের ভিত্তিতে শাস্তির আগেই অনেকে দল ছাড়ার ঘোষণা করেছেন। লক্ষ্মণ ও তাঁর অনুগামীরা নতুন মঞ্চ গড়বেন জেনেই প্রশান্তবাবু দলের রাজ্য নেতৃত্বকে জানিয়েছেন, জেলায় রাজনৈতিক ভাবেই তাঁরা এর মোকাবিলা করবেন।
দলত্যাগীদের মধ্যে তিন জন প্রশান্ত পাত্র, অমিয় ও প্রণববাবুকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্তও এ দিন অনুমোদিত হয়েছে রাজ্য কমিটিতে। জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর ওই তিন সদস্যকে আগেই সাসপেন্ড করা হয়েছিল। সাসপেনশন চলাকালীন কেউ দল ছাড়ার ঘোষণা করলে সিপিএমের গঠনতন্ত্রের ৮/২ ধারা অনুসারে তাঁদের বহিষ্কৃত বলে গণ্য করা হয়। একই কারণে পূর্ব মেদিনীপুর জেলা কমিটির সাসপেন্ডেড সদস্য বিজন রায়কেও বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত এ দিন অনুমোদিত হয়েছে। আর এ দিনই এঁরা সকলে লক্ষ্মণবাবুর নয়া মঞ্চের কমিটিতে নানা পদাধিকারী হয়েছেন। সভাপতি করা হয়েছে প্রত্যাশিত ভাবেই স্বয়ং লক্ষ্মণবাবুকে। অন্য দিকে আবার তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে, সিপিএমের রাজ্য কমিটির স্থায়ী সদস্য করা হয়েছে তাপস সিংহকে। যিনি এখন পূর্ব মেদিনীপুর জেলা কমিটিরও সদস্য।
প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু, বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র-সহ গোটা রাজ্য নেতৃত্বের বিরুদ্ধে আক্রমণ অব্যাহতই রেখেছেন লক্ষ্মণ। বুদ্ধবাবু ২০০৭ সালে মুখ্যমন্ত্রিত্ব ছেড়ে দিলে এবং তাঁর জায়গায় সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়কে দায়িত্ব দিলে এ ভাবে বামফ্রন্টের পতন হত না বলেও মন্তব্য করেছেন! সম্প্রতি তমলুকের প্রাক্তন সিপিএম সাংসদের মুখে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রশংসা চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিল। লক্ষ্মণবাবু এ দিন ব্যাখ্যা দিয়েছেন, অন্তরের জ্বালা থেকেই তিনি জঙ্গলমহল ও পাহাড়ের পরিস্থিতি মোকাবিলায় মুখ্যমন্ত্রী মমতার প্রশংসা করেছিলেন। তাঁর কথায়, “মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধবাবুর আমলে আমাদের জেলায় ৬৩ জন খুন, প্রায় ১৫ হাজার ঘরছাড়া হয়েছেন। মামলায় জর্জরিত প্রায় পাঁচ হাজার কর্মী-সমর্থক। তিনি রাজধর্ম প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি!”
জেলায় কানু সাহু সম্পাদক থাকা সত্ত্বেও প্রশান্ত প্রধানকে অস্থায়ী সম্পাদক করে রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর তরফে ভারপ্রাপ্ত নেতা রবীন দেব পূর্ব মেদিনীপুরে সমান্তরাল সংগঠন গড়েছিলেন বলেও অভিযোগ করেছেন লক্ষ্মণবাবু। যার জবাবে রবীনবাবু বলেছেন, “অসুস্থ কানুবাবু এক বছর দলের বৈঠকে আসতে না পারায় নিজেই চিঠি লিখে প্রশান্তবাবুকে দায়িত্ব দেওয়ার কথা বলেছিলেন। দার্জিলিং জেলায় সান্দোপাল লেপচা অসুস্থ বলে জীবেশ সরকারকে দায়িত্ব দেওয়া আছে। এমন ঘটনা অনেক বার ঘটেছে। দলের বাইরে গিয়েছেন বলে লক্ষ্মণবাবু এ সব ভুলে গিয়েছেন!”