প্রথম দফায় স্কুলে নিয়োগ পরীক্ষা পিছিয়ে গিয়েছিল ফর্ম-বিভ্রাটে। এ বার তা আটকে গেল স্থগিতাদেশে। পঞ্চম থেকে অষ্টম শ্রেণির শিক্ষক বাছাইয়ের জন্য ২৯ মার্চ অনুষ্ঠেয় পরীক্ষা (টেট)-র উপরে স্থগিতাদেশ জারি করেছে কলকাতা হাইকোর্ট। ফলে স্কুল সার্ভিস কমিশন বা এসএসসি-র জোড়া পরীক্ষা নিয়েই সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছে।
পঞ্চম থেকে দ্বাদশ, আটটি শ্রেণিতে পড়ানোর জন্য এ বার থেকে শিক্ষক নিয়োগের দু’টি পরীক্ষা নিচ্ছে এসএসসি। টেট এবং আরএলএসটি। পঞ্চম থেকে অষ্টম শ্রেণির শিক্ষক বাছাইয়ের পরীক্ষা প্রথমে হওয়ার কথা ছিল ৯ মার্চ। কিন্তু সর্বত্র সময়মতো ফর্ম পৌঁছে দিতে না-পারায় তা পিছিয়ে ২৯ মার্চ নেওয়া হবে বলে ঠিক হয়। বৃহস্পতিবার একটি মামলার জেরে সেই পরীক্ষা ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত স্থগিত রাখার নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট। তত দিনে লোকসভা নির্বাচন শুরু হয়ে যাবে। ভোটের ফল বেরোবে ১৬ মে। ভোট পর্ব না-মিটলে টেট নেওয়া যাবে কি না, তা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে।
আবার ভোট এবং এই স্থগিতাদেশের জেরে নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়ানোর শিক্ষক বাছাইয়ের পরীক্ষা (আরএলএসটি)-ও অনিশ্চিত হয়ে পড়ল। কারণ, টেটের পরে, এপ্রিলের মাঝামাঝি ওই পরীক্ষা নেওয়ার কথা ছিল। টেট স্থগিত হয়ে যাওয়ায় ধাক্কা খেল আরএলএসটি-ও।
আদালত সম্প্রতি রায় দিয়ে জানিয়েছে, মাদ্রাসার জন্য শিক্ষক বাছাই করে সুপারিশ করার এক্তিয়ার মাদ্রাসা সার্ভিস কমিশনের নেই। তাই ২৯ মার্চ ওই কমিশনের যে-পরীক্ষা হওয়ার কথা ছিল, তা-ও হচ্ছে না। এর মধ্যেই ফের এসএসসি-র পরীক্ষা নিয়ে ধাক্কা খেল রাজ্য সরকার।
প্রাথমিক স্কুলে শিক্ষক নিয়োগের জন্য ‘টিচার এলিজিবিলিটি টেস্ট’ বা টেট নেয় প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদ। আবার এসএসসি-র পরীক্ষা দু’ভাগ হয়ে যাওয়ার পরে তাদের প্রথম ভাগের পরীক্ষাকেও বলা হচ্ছে টেট। জট পাকিয়েছে সেই এসএসসি-টেট নিয়েই। রাজ্যে বিএড প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত প্রার্থীর সংখ্যা যথেষ্ট কম বলে প্রশিক্ষণহীন প্রার্থীদেরও নিয়োগের অনুমতি চেয়ে কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক এবং কাউন্সিল ফর টিচার এডুকেশন (এনসিটিই)-এর কাছে আবেদন জানিয়েছিল রাজ্য সরকার। এনসিটিই এ বছর ৩১ মার্চ পর্যন্ত প্রশিক্ষণহীন প্রার্থী নিয়োগের অনুমতি দেয়। নিয়ম না-মেনেই ২৯ মার্চ টেট নেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ তুলে হাইকোর্টে মামলা করেছেন কিছু প্রার্থী। যদিও এসএসসি-র চেয়ারম্যান সুবীরেশ ভট্টাচার্য জানান, ৩১ মার্চের মধ্যে প্রশিক্ষণহীন প্রার্থীরা পরীক্ষায় বসতে পারবেন বলে জানিয়েছে এনসিটিই। তাই ২৯ মার্চের পরীক্ষা মোটেই নিয়ম-বহির্ভূত নয়। তবে হাইকোর্টের রায়ে পরীক্ষা পিছিয়ে গিয়ে ১৬ মে-র পরে হলেও প্রশিক্ষণহীন প্রার্থীরা টেট দিতে পারবেন কি না, তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। সেই সময় প্রশিক্ষণহীনদের পরীক্ষায় বসতে পারার সম্ভাবনা ক্ষীণ বলে আইনজীবীদের একাংশের মত।
হাইকোর্টে আবেদনকারীদের বক্তব্য, এসএসসি-র আগের পরীক্ষায় তাঁরা সফল। চূড়ান্ত ‘প্যানেল’ বা মেধা-তালিকায় তাঁদের নাম আছে এবং যথেষ্ট শূন্য পদও রয়েছে। তাই এখনই তাঁদের নিয়োগ করা উচিত। রাজ্য সরকারের পক্ষে রাজ্যের অ্যাডভোকেট জেনারেল (এজি) বিমল চট্টোপাধ্যায় বলেন, সরকার এখনই টেট নেবে না বলে ঠিক করেছে। কারণ, এনসিটিই-র নিয়ম অনুযায়ী এটা নেওয়া যায় না। সুবীরেশবাবু পরে জানান, এজি এমন কথা বলেছেন কি না, তা তাঁর জানা নেই। তবে তিনি বলেন, “কমিশন পরীক্ষা নিতে প্রস্তুত। কিন্তু আদালত যখন রায় দিয়েছে, তখন তো পরীক্ষা স্থগিত রাখা ছাড়া আর কোনও উপায় নেই।”
আবেদনকারীদের আইনজীবী সুব্রত মুখোপাধ্যায় জানান, রাজ্য সরকার ২০১০ সালে কেন্দ্রকে বলেছিল, প্রশিক্ষিতদের আগে নিয়োগ করা হবে। তার পরে আসন শূন্য থাকলে তবেই তারা প্রশিক্ষণহীন প্রার্থীদের নিয়োগ করবে। কিন্তু রাজ্য সরকার কথা রাখছে না। এসএসসি-র আগের পরীক্ষার প্যানেল এনসিটিই-র নিয়ম অনুযায়ী দেড় বছর বৈধ থাকার কথা। তাই এখনই নতুন করে টেট নেওয়ার বিজ্ঞাপন দেওয়া যায় না। অথচ সেই নিয়মকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ২৯ মার্চ টেট নেওয়ার বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে।
এজি আদালতে জানান, তাঁরাই যখন পরীক্ষা বন্ধ করে দিচ্ছেন, তখন স্থগিতাদেশ দেওয়ার কোনও প্রয়োজন নেই। বিচারপতি দেবাশিস করগুপ্ত অবশ্য এই প্রস্তাবে সম্মত হননি।
তিনি জানান, ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত টেট স্থগিত। ২১ এপ্রিল মামলাটির ফের শুনানি হবে।
নতুন সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে বিতর্ক, জটিলতা পিছু ছাড়ছে না এসএসসি-র। ২০১২-র জুলাইয়ে কমিশন যে-পরীক্ষা নিয়েছিল, তাতে প্রশ্নপত্র বিভ্রাটের জেরে পাঁচটি কেন্দ্রে ফের পরীক্ষা নিতে হয় সেই বছরেরই সেপ্টেম্বরে। তার ফল বেরিয়ে কাউন্সেলিং শুরু হয় গত বছরের শেষে। কিন্তু চূড়ান্ত মেধা-তালিকায় নাম থাকা সত্ত্বেও তাঁরা চাকরির সুযোগ পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ তুলে আন্দোলন করছেন অনেক প্রার্থী। কমিশনের চেয়ারম্যান-পদেও বদল হয়েছে দফায় দফায়। এখন আবার পরবর্তী পরীক্ষা নিয়ে এই জটিলতা। কমিশনের এক কর্তার কথায়, “প্রশিক্ষণহীন প্রার্থীরা পরীক্ষায় বসতে পারবেন কি না, রায়ের প্রতিলিপি পেলে তা খতিয়ে দেখা হবে।”
টেট স্থগিত হয়ে যাওয়ায় রাজ্য সরকারকেই দায়ী করেছে সিপিএমের যুব সংগঠন ডিওয়াইএফআই। চাকরিপ্রার্থীদের অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দেওয়ার প্রতিবাদে আজ, শুক্রবার জেলায় জেলায় এসএসসি দফতরের সামনে বিক্ষোভ-কর্মসূচি নিয়েছে তারা। ডিওয়াইএফের রাজ্য সভাপতি সায়নদীপ মিত্র বলেন, “তরুণ-তরুণীদের ভবিষ্যৎ অন্ধকারে ঠেলে দিল এই অপদার্থ সরকার!” তাঁদের দাবি, এসএসসি-র আগের পরীক্ষায় সফলদের এ বছরের ৩১ মার্চের মধ্যে নিয়োগ করা উচিত। প্রশিক্ষণহীন প্রার্থীদের জন্য আরও শিক্ষক-শিক্ষণ কলেজ গড়ার দাবিও তুলেছে ডিওয়াইএফআই।
মাদ্রাসায় শিক্ষক নিয়োগের কী হবে? শিক্ষক নিয়োগের জন্য মাদ্রাসা সার্ভিস কমিশনের সুপারিশ করার ক্ষমতা নেই বলে সম্প্রতি রায় দিয়েছে হাইকোর্ট। ওই কমিশনের চেয়ারম্যান আব্দুর রউফ জানান, ৮৮ হাজার প্রার্থী ২৯ মার্চের পরীক্ষায় বসার জন্য আবেদন জানিয়েছিলেন। তাঁদের কী হবে, তা জানতে চেয়ে আবেদন জানানো হবে আদালতের কাছে।