সিগারেট-গুটখা বন্ধে জরিমানার নির্দেশ পুলিশকে

রাস্তায় বেরোনোর সময়ে তামাকসেবীরা সাবধান! এ বার থেকে রাস্তায় গুটখা-সিগারেট খেলেই ধরবে পুলিশ। ২০০ টাকা জরিমানা দিয়ে তবে ছাড়া পাওয়া যাবে। অন্তত কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের নির্দেশ তেমনই। রাস্তায় সিগারেট-গুটখা খেলে জরিমানা নেওয়ার আইন চালু হয়েছে ২০০৩ সাল থেকে। কোনও স্কুল-কলেজের সামনে গুটখা-সিগারেট বিক্রি করলেও একই আইনে বিক্রেতার জরিমানা হওয়ার কথা। কিন্তু নজরদারির অভাবে এ রাজ্যে সেই ব্যবস্থা এত দিন কার্যকর হত না।

Advertisement

কুন্তক চট্টোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ২২ মে ২০১৪ ০২:৫৩
Share:

এখন যেমন। বুধবার শহরে।—নিজস্ব চিত্র।

রাস্তায় বেরোনোর সময়ে তামাকসেবীরা সাবধান! এ বার থেকে রাস্তায় গুটখা-সিগারেট খেলেই ধরবে পুলিশ। ২০০ টাকা জরিমানা দিয়ে তবে ছাড়া পাওয়া যাবে। অন্তত কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের নির্দেশ তেমনই।

Advertisement

রাস্তায় সিগারেট-গুটখা খেলে জরিমানা নেওয়ার আইন চালু হয়েছে ২০০৩ সাল থেকে। কোনও স্কুল-কলেজের সামনে গুটখা-সিগারেট বিক্রি করলেও একই আইনে বিক্রেতার জরিমানা হওয়ার কথা। কিন্তু নজরদারির অভাবে এ রাজ্যে সেই ব্যবস্থা এত দিন কার্যকর হত না। অন্য কাজের অজুহাত দিয়ে দায়িত্ব এড়িয়ে যেত স্বাস্থ্য দফতর। এই দফতরের হাতেই মূলত এত দিন এই জরিমানা আদায়ের দায়িত্ব ছিল। কিন্তু ওই দফতরে কোনও পরিকাঠামো না থাকায় কার্যত খাতায়-কলমে রয়ে গিয়েছে আইনটি। এ বার স্বাস্থ্য দফতরের পাশপাশি পুলিশকেও অবিলম্বে এই আইন কড়া হাতে কার্যকর করার নির্দেশ দিয়েছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। পুলিশ এই কাজ করতে কতটা সফল হচ্ছে, সে ব্যাপারে নজর রাখবে কেন্দ্র।

গুটখা-পানমশলা-সিগারেট খাওয়ার ফলে যে ভাবে দেশে গলা, মুখ ও ফুসফুসের ক্যানসার বাড়ছে তাতে উদ্বিগ্ন ক্যানসার চিকিত্‌সকেরা। এ ব্যাপারে বিভিন্ন রাজ্যের পুলিশ যাতে অতি সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করে, তার আর্জি জানাতে সম্প্রতি ক্যানসার চিকিত্‌সকদের একটি দল দিল্লিতে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রসচিব অনিল গোস্বামীর সঙ্গে দেখা করেছিলেন। তার ফলও মিলেছে। চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহেই কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রসচিব প্রতিটি রাজ্যের ডিজি-কে চিঠি পাঠিয়ে ২০০৩ সালের তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন কার্যকর করতে পুলিশকে উদ্যোগী হতে বলেছেন।

Advertisement

কী ভাবে পুলিশ ওই আইন কার্যকর করবে, সে ব্যাপারে একটি নির্দেশিকাও জারি করেছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রসচিব। নির্দেশিকায় বলা হয়েছে: এই আইন ভাঙার ঘটনায় কত জনের কাছ থেকে জরিমানা আদায় করা হয়েছে, তা নিয়ে প্রতিটি জেলার মাসিক অপরাধদমন বৈঠকে (ক্রাইম মিটিং) আলোচনা করতে হবে। আইন কার্যকর করতে তারা কী ব্যবস্থা নিয়েছে, তা জানিয়ে প্রতি চার মাস অন্তর প্রতিটি রাজ্যকে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক ও স্বাস্থ্য মন্ত্রকে রিপোর্ট পাঠাতে হবে। সেই রিপোর্টের ভিত্তিতেই বিভিন্ন রাজ্যকে পরবর্তী নির্দেশ দেবে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক। প্রতিটি রাজ্যের ডিজি-কে ওই আইন প্রণয়নে ব্যক্তিগত ভাবে উদ্যোগী হওয়ার কথাও বলেছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রসচিব।

মুম্বইয়ের টাটা মেমোরিয়াল হাসপাতালের ক্যানসার চিকিত্‌সক পঙ্কজ চতুর্বেদীর দাবি, সারা দেশের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গেই পানমশলা-গুটখা-সিগারেটের ব্যবহার বেশি। তাঁর হাসপাতালে মুখ ও গলার যে সব রোগীর চিকিত্‌সা হয়, সেখানে পশ্চিমবঙ্গ থেকে যাওয়া রোগীর সংখ্যাই সর্বাধিক। তাই সম্প্রতি কলকাতায় এসে শহরের ক্যানসার চিকিত্‌সক গৌতম মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে রাজ্য পুলিশের ডিজি-র সঙ্গে দেখা করেছিলেন পঙ্কজবাবু। ডিজি-কে ব্যক্তিগত ভাবে ২০০৩ সালের তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন কার্যকর করতে উদ্যোগী হতে অনুরোধ করেছিলেন তিনি। ওই চিকিত্‌সকের আক্ষেপ, সিকিম কিংবা হিমাচলপ্রদেশের মতো ছোট রাজ্য-শহরগুলিতে যেখানে প্রকাশ্যে ধূমপান করলে পুলিশ ধরে, সেখানে কলকাতায় এবং রাজ্যের অন্যত্র নাবালকদেরও অনায়াসে তামাকজাত পণ্য বিক্রি করেন দোকানিরা।

তামাকবিরোধী আইন অনুযায়ী, রাজ্যের স্বাস্থ্য কিংবা খাদ্য দফতরের অফিসারেরা ছাড়াও পুলিশের সাব-ইনস্পেক্টর বা তার থেকে উচ্চপদস্থ অফিসারেরাও প্রকাশ্যে ধূমপায়ী ও তামাক-আইনভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারেন। কিন্তু পরিচিত ছবি বলে, রাজ্যের পুলিশের মধ্যেও ধূমপান ও তার আইনের প্রয়োগ নিয়ে সচেতনতা কম। পুলিশকর্মীদের একাংশ উর্দি পরেই রাস্তায় দাঁড়িয়ে ধূমপান করছেন, এমন দৃশ্যও হামেশাই দেখা যায় এ রাজ্যে। মাস কয়েক আগেই এ ব্যাপারে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা কলকাতার পুলিশ অফিসারদের নিয়ে ধূমপানবিরোধী একটি কর্মশালা করেছিল। তার পরেও পরিস্থিতির কোনও পরিবর্তন হয়নি।

পুলিশ তো দূর অস্ত্‌, এ রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতরের অফিসারেরাও এই আইন রোধে কড়া হন না বলে অভিযোগ রয়েছে। রাজ্যে এক বছর আগেই গুটখার বিক্রি বন্ধ হয়েছিল। কিন্তু বাস্তব ছবি বলে, রাজ্যের জেলা তো ছার, খাস কলকাতাতেও ঘুরপথে (পানমশলা ও জর্দা আলাদা প্যাকেটে) গুটখা বিক্রিই চলছে।

অথচ, সিকিম বা হিমাচল ছাড়াও এ দেশেরই একাধিক রাজ্যের পুলিশ কিন্তু তামাক-নিয়ন্ত্রণ আইন নিয়ে যথেষ্ট কড়া। তাঁদের রাজ্যে এ নিয়ে কী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, সে ব্যাপারে নিয়মিত তথ্যও প্রকাশ করে তারা। যেমন, কেরল পুলিশের ওয়েবসাইটেই এ ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য দেওয়া রয়েছে। ওয়েবসাইট-ই বলছে, ওই রাজ্যে মহিলা ও শিশুদের উপরে অত্যাচারের মতোই কেরলে তামাক-অপরাধকেও যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়। কর্নাটকে আবার স্বাস্থ্য দফতরের তামাক-বিরোধী শাখার নিজস্ব ওয়েবসাইট রয়েছে। (অ্যান্টি টোবাকো সেল)। সেখানে গেলেই তাদের কাজকর্ম এবং তামাক-বিরোধী নানা প্রচার-তথ্য মিলবে।

কিন্তু এ রাজ্যে তেমন উদ্যোগ আছে কী? স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর, তামাকের ব্যবহারের উপরে একটি মনিটরিং কমিটি রয়েছে। কিন্তু তা কতটা কার্যকর, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে খোদ স্বাস্থ্য ভবনের অন্দরেই। পাশাপাশি এই ধরনের আইন লাগু করার ক্ষেত্রে দফতরে কর্মীর অভাবও রয়েছে। রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতরের ফুড-সেফটি কমিশনার গৌতম ঘোষ বলছেন, “এত দিন পুলিশের উপরেই নির্ভর করতে হত। পুলিশ আরও সক্রিয় হলে খুবই ভাল ব্যাপার।”

একই মত ক্যানসার-চিকিত্‌সকদেরও। তাঁরা বলছেন, রাজ্যে ড্রাগ কন্ট্রোল বা স্বাস্থ্য দফতর দোকানে-দোকানে ঘুরে তামাক নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। এ ক্ষেত্রে পুলিশি সক্রিয়তাই সব থেকে বড় হাতিয়ার হতে পারে। তবে শহরের ক্যানসার-চিকিত্‌সক গৌতম মুখোপাধ্যায় কেন্দ্রীয় সরকারের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, “এই আইন শুধু পুলিশ দিয়ে লাগু করলেই হবে না। জনমানসে সচেতনতা বাড়ানোও জরুরি।”

লালবাজারের এক পুলিশকর্তা বলেন, “কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রসচিব যখন নির্দেশ দিয়েছেন, তা মানা হবেই। কিন্তু রাস্তায় নেমে হাতেকলমে কাজ শুরু না করলে বোঝা যাবে না এ কাজে আমরা কতটা সফল হতে পারব।”

কিন্তু নানা কাজের মধ্যে পুলিশের পক্ষে এই দায়িত্ব সামলানো সম্ভব? পঙ্কজ চতুর্বেদী বলেন, “পুলিশের উপরে যে অত্যাধিক চাপ পড়ে যাচ্ছে তা অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু বর্তমান যে আইনটি রয়েছে, তা যত দিন না বদল হচ্ছে, পুলিশকে এই অতিরিক্ত চাপ নিতেই হবে। মানুষের জীবনের কাছে বাকি সবই তুচ্ছ।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন