সাই গ্রাউন্ডের মাটিতীর্থ উৎসবে দ্বিতীয় দিনেই ফাঁকা স্টল। ছবি: উদিত সিংহ।
একদিনেই ‘ফ্লপ শো’ মাটিতীর্থ কৃষিকথা।
উৎসবের দ্বিতীয় দিনে বাঁকুড়ার মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ বিভাগের স্টলে বসে খোলাখুলি এ কথা বলেই ফেললেন এক্সটেনশন অফিসার রাধেশ্যাম রায়। সারাদিনে মাছি তাড়াতে তাড়াতে হতাশ তিনি। বললেন, “আগের দিন ভালই ভিড় হয়েছিল। কিন্তু আজ তো পুরো ফ্লপ শো।”
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বীজ নিগমের স্টলে বসে ফিল্ড সুপারভাইজার সদানন্দ সাহাও বলে ফেললেন, “বিভিন্ন বীজের গুণাগুণ, চাষের সময়, পরিমাণ, পরিচর্যা নিয়ে চাষিদের পরামর্শ দিতেই এই স্টলে হাজির রয়েছি। কিন্তু যাঁদের পরামর্শ দরকার তাঁদেরই দেখা নেই।”
ফাঁকা পড়ে ছিল জলসম্পদ অনুসন্ধান ও উন্নয়ন বিভাগের স্টলও। সকাল থেকে খুব বেশি হলে ৪০ জন নানা খোঁজখবর নিতে বসেছিলেন সেখানে। স্টলে বসেই ক্ষুদ্র সেচ দফতরের কৃষি বিশেষজ্ঞ উদয়শঙ্কর রায় বলেন, “গত কাল ক্ষুদ্র সেচের সমস্যা, কৃষি ক্ষেত্রে জলের ব্যবহার নিয়ে জানতে এর দশগুন মানুষ এসেছিলেন। আজ...”
প্রশাসনের হিসেব অনুযায়ী সোমবার সাই কমপ্লেক্স লাগোয়া এই মাঠেই দক্ষিণবঙ্গের ১২টি জেলার ১ লক্ষ ২৫ হাজার লোক ভিড় করেছিলেন। সকাল থেকে বাস ভর্তি করে দলে দলে লোক ঢুকতে দেখাও গিয়েছিল। যদিও দু’চারজনের সঙ্গে কথা বলতেই দেখা গিয়েছিল ছবিটা গোলমেলে। চাষি নয়, বরং রাজারহাটের ইঞ্জিনিয়ার থেকে বইমেলা দেখতে আসা মানুষের খোঁজ মিলেছিল। কেন মেলায় এসেছেন, সে প্রশ্নের উত্তরেও মিলেছিল আশ্চর্য সব জবাব।
তবে অনুষ্ঠান সূচী অনুযায়ী মঙ্গলবার থেকে চাষিদের নিয়ে নানা সেমিনার ও প্রশিক্ষণ হওয়ার কথা ছিল। এমনটা দাবি করেছিলেন বর্ধমানের জেলাশাসক সৌমিত্র মোহনও। কিন্তু মঙ্গলবার গিয়ে দেখা গেল, সব ধু ধু। সরকারি সাজানো স্টলে, হরেক রকম চাষের যন্ত্রপাতি নিয়ে, নতুন নতুন ধানের বীজের খোঁজ নিয়ে চুপচাপ বসে রয়েছে অধিকারিকেরা। স্টলের সামনে দিয়ে কেউ গেলেই প্রায় দৌড়ে তাঁকে পাকড়াচ্ছিলেন তাঁরা।
হুগলি জেলার প্রাণিসম্পদ বিভাগের স্টলে গিয়ে দেখা গেল, সেটিতেও কেউ দাঁড়িয়ে নেই। সহ-অধিকর্তা বাসুদেব ঘোষ বললেন, “সকাল থেকে দু-চার জন এসেছিলেন। আমরা আমাদের মতো স্টল সাজিয়ে বসে রয়েছি। মানুষ না এলে আমরা আর কাকে প্রাণিপালন নিয়ে বলব!” পশ্চিমবঙ্গ বাজ্য বীজ নিগমের স্টলে গোবিন্দভোগ-সহ নানা জাতের সুগন্ধী ও উচ্চফলনশীল ধানের বীজ সম্পর্কে রয়েছে নানা তথ্য। রাজ্যে উৎপাদিত গোবিন্দভোগ চাল রফতানিও হয় বিদেশ বা ভিন রাজ্যে। কিন্তু মাটিতীর্থে আসা আধিকারিকেরা জানিয়েছেন, চাষিদের বীজগুলি নিয়ে তেমন আগ্রহই নেই। বীরভূম জেলার স্টলে বসে এগ্রিকালচার দফতরের আধিকারিক নদীয়ানন্দ দাস বলেন, “বীরভূম জেলায় এমন বেশ কিছু ধান ও শীতকালীন ফসল উৎপাদিত হয়, যা গোটা রাজ্যে চাষ হতে পারে। কিন্তু স্টলে তেমন চাষিদের উপস্থিতি না থাকায় সারাদিন বসেই থাকতে হচ্ছে।” নদিয়ার মৎস্য চাষের স্টলেও কেউ আসেন নি বলে আক্ষেপ আধিকারিক সব্যসাচী রায়ের।
আবার একটি স্টলে দেখা গেল উল্টো ছবি। রাজ্য ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতরের ‘ওভার দি কাউন্টার’ নামের প্রকল্প থেকে জমির ব্যবহার, মাপজোক, জমির দলিল বা খতিয়ানের নানা খুঁটিনাটি সম্পর্কে জানা যাচ্ছিল। কিন্তু স্টলে গিয়ে দেখা গেল, খণ্ডঘোষের রূপসা গ্রাম থেকে সাতসকালে এসে বসে রয়েছেন দু’ভাই অমিত ও অসিতকুমার ঘোষ। স্টলে কোনও সরকারি কর্মী নেই। জিজ্ঞাসা করাতেই বিরক্ত মুখে বললেন, “৩০ কিলোমিটার দূরের গ্রাম থেকে বাসে করে এসে বসে রয়েছি। স্টলে কেউ হাজির নেই যে কিছু জানতে পারব!”
তবে এর মধ্যেই প্রাণিসম্পদ বিকাশ দফতরের বর্ধমান জেলার স্টলে দেখা গেল গুটি কতক লোককে নিয়ে চলছে আলোচনাসভা। তবে সামগ্রিক ভাবে সেই স্টলটিও ফাঁকা। বিভাগীয় আধিকারিক ছাড়া আর কেউ ছিলেন না সেখানে। উত্তর ২৪ পরগনার স্টলে দেখা হল গলসির বড়মুড়িয়া গ্রামের মুনাফ আলি নামে এক চাষির সঙ্গে। কৃষি যন্ত্রপাতির খোঁজ নিচ্ছিলেন তিনি। স্টলের দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিক সৌম্য ঘণ্টি বললেন, “আশা করেছিলাম বিশাল সংখ্যক মানুষ চাষের যন্ত্রপাতি দেখতে আসবেন। কই তাঁরা?”
পূর্ব মেদিনীপুরের স্টলে অবশ্য কিছুটা ভিড় ছিল। জেলার সহ কৃষি অধিকর্তা মলয়কুমার মেইকাপের দাবি, “বেশ কিছু মানুষ চাষবাস নিয়ে খোঁজ নিতে এসেছিলেন। তবে যতটা ভিড় আশা করিছিলাম, তা পাইনি।”
দুপুরে মূলমঞ্চের পাশে একটি কৃষি সংক্রান্ত আলোচনা মঞ্চে মুরগি পালন নিয়ে আলোচনা হওয়ার কথা ছিল। তিনটে নাগাদ দেখা গিয়েছে, মঞ্চে কয়েকজন আধিকারিক বসে থাকলেও আলোচনা শুনতে হাজির হননি কোনও মুরগি পালকই। স্থানীয় মানুষজনেরও সেভাবে নজর কাড়েনি এই উৎসব।
বর্ধমানের অতিরিক্ত জেলাশাসক উন্নয়ন প্রণবকুমার বিশ্বাস অবশ্য দাবি করেন, “এ দিন ওই মাঠে চারটি সেমিনার হয়েছে। পশুপালন দফতরের সেমিনারে উপস্থিত ছিলেন ৪৭০জন। কৃষি বিপণন দফতরের সেমিনারে হাজির ছিলেন ১৩০ জন, ১২০ জন করে উপস্থিত ছিলেন মৎস্য পালন ও উদ্যান পালন দফতরের সেমিনারে।” আজ, বুধবার কৃষি দফতরের নানা সেমিনারে কয়েকটি জেলার অন্তত হাজার খানেক চাষি হাজির থাকবেন বলে আশা প্রশাসনের।
উৎসবের হাল শুনে বর্ধমান ১ ব্লকের এক তৃণমূল নেতার আক্ষেপ, “আগের দিন দল থেকে আমাকে ৩০০ লোক আনার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। এনে দিয়েছিলাম। বললে এ দিনও ব্যবস্থা করে দিতাম।”