সোনা আগুন, রুজি হারিয়ে ঘরে ফিরছেন কারিগরেরা

কোথায় হাওড়ার ডোমজুড় আর কোথায় পশ্চিম মেদিনীপুরের ঘাটাল। আলাদা দু’টো জেলা। ভোটের কেন্দ্রও আলাদা। কিন্তু মিল আছে এক জায়গায়। তা হল, গয়নার কারিগরদের হাতের জাদু।

Advertisement

নুরুল আবসার ও অভিজিৎ চক্রবর্তী

উলুবেড়িয়া ও ঘাটাল শেষ আপডেট: ০৯ মার্চ ২০১৪ ০৩:২৯
Share:

কোথায় হাওড়ার ডোমজুড় আর কোথায় পশ্চিম মেদিনীপুরের ঘাটাল। আলাদা দু’টো জেলা। ভোটের কেন্দ্রও আলাদা। কিন্তু মিল আছে এক জায়গায়। তা হল, গয়নার কারিগরদের হাতের জাদু।

Advertisement

হাতের কাজের জোরেই রাজ্যের এই দুই এলাকা থেকে হাজার-হাজার কারিগর পাড়ি দিয়েছিলেন মুম্বই, দিল্লি-সহ দেশের নানা মুলুকে। ভিন্ রাজ্যের উপার্জনে গ্রামের বাড়িতে জমি-জমাও করেছিলেন তাঁরা। কিন্তু সোনার দাম আকাশছোঁয়া হয়ে যাওয়ায় স্বর্ণালঙ্কারের চাহিদা কমেছে। তার জায়গা নিচ্ছে অন্য নানা উপহার। বিশেষত বিয়েশাদির ক্ষেত্রে মধ্যবিত্ত ঝুঁকছে ইন্ডাকশন হিটার বা মাইক্রোওয়েভ আভেনের গেরস্থালির নানা যন্ত্রপাতির দিকে।

ফলে, দ্রুত হারে কাজ কমছে কারিগরদেরও। বাধ্য হয়ে তাঁরা একে-একে ঘরে ফিরছেন। কিন্তু ফিরলে কী হবে? এখানেও কাজ নেই। যে কাজ তাঁরা জানতেন, তা অচল। অন্য কিছু তাঁরা জানেন না। বাধ্য হয়ে কেউ রিকশা চালাচ্ছেন, কেউ মুদির দোকান। কেউ আবার রুজি খুঁজছেন ১০০ দিনের প্রকল্পে। সেই সবই আসলে বে-হাওয়ায় ঘুড়ি ওড়ানোর মতো।

Advertisement

বছরের পর বছর ধরে ডোমজুড় ও ঘাটালের যুবকেরা সোনার কারিগর হিসাবে কাজ করে আসছেন। ঘরে-ঘরে গয়না তৈরির আয়োজন। মুম্বই-এর জাভেরি বাজারের সিংহভাগ কারিগরই ঘাটাল এবং ডোমজুড় থেকে যাওয়া। ২০০৬ সালের এক সমীক্ষায় দেখা গিয়েছিল, ৬৭ হাজার কারিগর এই শিল্পে যুক্ত। এই সব এলাকা থেকে যাঁরা মুম্বই-দিল্লিতে গিয়েছিলেন, তাঁদের সংখ্যা ধরেই সমীক্ষা হয়েছিল। পরে সংখ্যাটা আরও অঅনেক বেড়েছে। সোনার কাজের দৌলতেই ঘাটাল ও ডোমজুড়ের বিভিন্ন এলাকায় সমৃদ্ধি এসেছিল। কিন্তু বছর দেড়েক হল ছবিটা উল্টে গিয়েছে।

পিংলার পিণ্ডরুই গ্রামের চিরঞ্জিত সামন্ত দীর্ঘদিন দিল্লিতে ছিলেন। তাঁর কথায়, “আমি কুড়ি বছর ধরে ওখানে সোনার কাজ করেছি। উপার্জনের টাকায় গ্রামে বাড়ি করেছি। মাস পাঁচেক হল দিল্লিতে কোনও কাজ নেই। ফিরে এসেও দেখলাম একই অবস্থা। এখন গ্রামেই একটি দর্জির দোকানে কাজ শিখছি।” দাসপুরের ঘনশ্যামবাটির বাসিন্দা শেখ সফিউল বলেন, “রাজস্থানে ছিলাম। মাস দুয়েক আগে বাড়ি ফিরে আসি। ১০০ দিনের কাজ করছি।” ঘাটালের পান্না গ্রামের বুবাই পাল মুম্বইয়ের জাভেরি বাজারে দীর্ঘ দশ বছর কাজ করার পরে এখন হকারি করছেন। মুম্বই থেকে ফিরে মুদিখানার দোকান করেছেন ডোমজুড়ের দিলিপ মান্না। তাঁর কথায়, “সোনার কাজ ছাড়া আর কোনও কাজ জানি না। যা উপার্জন করেছিলাম, ব্যবসায় লাগালাম।”

কেন এই হাল?

কারিগর ও স্থানীয় ব্যবসায়ীদের মতে, সোনার দামের ওঠা-নামা এবং স্বর্ণালঙ্কারের উপরে কর বড় কারণ। বছর দু’তিন ধরে সোনার দাম বাড়তে-বাড়তে বর্তমানে লাগামছাড়া। দেশের বিভিন্ন এলাকায় ছোট ও মাঝারি গয়নার দোকান মূলত গরিব ও মধ্যবিত্ত ক্রেতাদের উপরেই নির্ভর করে। লাগামছাড়া দাম ওই শ্রেণির ক্রেতাদের বিমুখ করেছে। ফলে মন্দা দেখা দিয়েছে ব্যবসায়। অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। ডোমজুড় স্বর্ণ-রৌপ্য শিল্পী সমিতি সূত্রের খবর, এক সময়ে যেখানে সারা ডোমজুড় জুড়ে সাত হাজার কারখানা ছিল এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে হাজার চারেকে। কারিগরদের সংখ্যাও কমছে উল্লেখযোগ্য ভাবে।

কাজ হারানো কারিগর ও ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, এই পরিস্থিতির সুযোগ নিচ্ছেন বড় ব্যবসায়ীরা। দিল্লির করোলবাগের স্বর্ণকার ব্যবসায়ী সমিতির পক্ষে সমর মাঝি, তাপস জানা, অমল সামন্তেরা বলেন, “ব্যবসায় যখন রমরমা ছিল, বড় দোকানগুলি ছোট ব্যবসায়ী এবং কারিগরদের কাজের বরাতের সঙ্গে কাঁচামাল অর্থাৎ সোনাও দিয়ে দিতেন। এখন তাদেরই কাজের বরাত দেওয়া হচ্ছে, যাদের হাতে সোনা মজুত আছে। বেশির ভাগ ছোট ব্যবসায়ী এবং কারিগরের হাতে সোনা নেই। ফলে তাঁরা কাজ পাচ্ছেন না।” মুম্বইয়ের বঙ্গীয় স্বর্ণশিল্পী কল্যাণ সঙ্ঘের পক্ষে অজিত মাজিরও একই বক্তব্য।

ডোমজুড় স্বর্ণ-রৌপ্য শিল্পী সমিতির সভাপতি বিশ্বনাথ মুখোপাধ্যায় বলেন, “শুধু মুম্বই-দিল্লি নয়, এই সমস্যা সারা দেশে। এখানেও আমরা কলকাতার বড় ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে বরাত এনে কাজ করি। এখন নিজের হাে সোনা থাকলে তবেই বরাত মিলছে। সোনা মজুত করার টাকা না-থাকায় অনেকে কাজ ছেড়ে দিচ্ছেন।” এই সংগঠনগুলির দাবি, কেন্দ্রীয় সরকার যে ১৩ শতাংশ হারে সোনার উপরে বিক্রয় কর নেয়, তা তুলে দিলে পরিস্থিতি পাল্টাবে। বিশ্বনাথবাবু বলেন, “সরকারের উচিত কারিগরদের উন্নতমানের প্রশিক্ষণ দেওয়া। তাতে তাঁরা কম সময়ের মধ্যে বেশি অলঙ্কার তৈরি করতে পারবেন। তাতে উৎপাদন ব্যয় কমবে। ফলে গয়নার দামও কমবে।”

পশ্চিম মেদিনীপুরে এখনও এই ধরনের কোনও সরকারি উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। তবে হাওড়া জেলা প্রশাসনের এক কর্তা জানান, অঙ্কুরহাটিতে একটি জুয়েলারি হাব তৈরির পরিকল্পনা হয়েছে। সেটি তৈরি হলে কারিগরদের প্রশিক্ষণ-সহ নানা সুযোগ দেওয়ার ব্যবস্থা থাকবে।

আপাতত এই আশ্বাসই ভরসা কারিগরদের।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন