নির্যাতিতাকে (একেবারে বাঁ দিকে আড়ালে) সঙ্গে নিয়ে বুদবুদের কলমডাঙার জঙ্গলে তদন্তে সিআইডি দল। শনিবার। ছবি:বিকাশ মশান
সিআইডি-র সঙ্গে বুদবুদে বাপের বাড়িতে গিয়ে তদন্তকারী অফিসারদের সামনেই সিবিআই তদন্ত দাবি করলেন সাত্তোরের নির্যাতিতা বধূ। শুধু বুদবুদে নয়, বীরভূমের ইলামবাজারে বনভিলা জঙ্গলে নিয়ে গিয়েও তাঁকে মারধর করা হয়েছিল বলে তাঁর অভিযোগ।
এক বিজেপি কর্মীকে খুঁজতে এসে তাঁর কাকিমাকে বাপের বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে রাতভর মারধর ও সর্বাঙ্গে বিছুটি ঘষে দেওয়ার অভিযোগ তিন সপ্তাহের পুরনো। ওই ঘটনায় বীরভূম জেলা পুলিশের কয়েক জনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা হলেও কেউ গ্রেফতার হয়নি।
শনিবার বীরভূমের সাত্তোর থেকে বর্ধমানের বুদবুদে নির্যাতিতাকে নিয়ে আসে সিআইডি। উদ্দেশ্য ছিল, গোটা ঘটনাটি ঠিক কী ভাবে ঘটেছিল, তা বোঝা। অফিসারদের সঙ্গে ঘটনাস্থলে ঘুরতে-ঘুরতেই নির্যাতিতা অধৈর্য হয়ে বলে ওঠেন, “এ সব করে কী হবে? ঘটনার এত দিন পরেও তো এক জনও গ্রেফতার হয়নি!” তাঁর দাবি, “এক মাত্র সিবিআই তদন্ত হলেই প্রকৃত সত্য প্রকাশ হবে। আমি সিবিআই তদন্ত চাই।”
এই ঘটনায় সিবিআই তদন্ত চেয়ে আগে বুদবুদে মিছিল করেছে বিজেপি। দলের রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহের দাবি, “সিআইডি মামলাটা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করছে। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মহিলা হলেও তাঁর পুলিশকে তৎপর হওয়ার নির্দেশ দিচ্ছেন না। বাধ্য হয়েই নির্যাতিতা সিবিআই চেয়েছেন।” তৃণমূল নেতারা অবশ্য এর প্রতিবাদ করার বদলে এই প্রসঙ্গ এড়াতেই বেশি ব্যগ্র। পাড়ুইয়ের সাত্তোর যাঁর নিজের এলাকায় পড়ে, তৃণমূলের বীরভূম জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল এ নিয়ে মন্তব্য করতে চাননি। বোলপুরের বিধায়ক তথা রাজ্যের মৎস্যমন্ত্রী চন্দ্রনাথ সিংহ বলেন, “বিষয়টি পুলিশ দেখছে। এ নিয়ে আমি কী বলব?”
সাত্তোরের ওই বধূর বাপের বাড়ি বুদবুদের কলমডাঙা গ্রামে। গত ১৭ জানুয়ারি রাতে সেখান থেকেই তাঁকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। পুলিশের সঙ্গে তৃণমূলের সাত্তোর অঞ্চল সম্পাদক শেখ মুস্তফা ও তাঁর দলবল ছিল বলেও অভিযোগ। যদিও লিখিত অভিযোগে তাঁদের কারও নাম নেই। তাঁরা অভিযোগ স্বীকারও করেননি। ১৯ জানুয়ারি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে সিআইডি তদন্তের নির্দেশ দেয় কলকাতা হাইকোর্ট। কিন্তু তার পরেও কোনও ধরপাকড় হয়নি। নির্যাতিতার পরিবারের অভিযোগ, শাসকদলের চাপেই সিআইডি তদন্তে ঢিলে দিচ্ছে। এ দিন শেখ মুস্তফা অবশ্য দাবি করেন, “আমাদের দিক থেকে কোনও চাপ নেই। আমরা কেনই বা চাপ দিতে যাব? সব মিথ্যে কথা বলা হচ্ছে।”
এ দিন সাত্তোর থেকে নির্যাতিতা বধূকে নিয়ে সকাল ১০টা নাগাদ কলমডাঙা গ্রামে ঢোকে সিআইডি-র পাঁচ সদস্যের দল। যাঁকে খুঁজতে গিয়ে এত ঘটনা, সেই বিজেপি কর্মীর মা বধূটির সঙ্গে ছিলেন। তাঁর বছর ছয়েকের ছেলেও সঙ্গে গিয়েছিল। বাড়ির কাছেই যে জঙ্গলে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল বলে বধূর অভিযোগ, সেখানেই প্রথমে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয়। ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়ে সিআইডি অফিসারেরা তাঁর কাছে ঘটনার বর্ণনা ও অভিযুক্তদের নাম জানতে চান। যে গাছে বেঁধে অত্যাচার চালানো হয়েছিল, কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজির পর সেটি চিনতে পারেন তিনি। অভিনয় করে দেখান, কী ভাবে মাফলার দিয়ে তাঁর হাত বেঁধে পিছন থেকে লাঠি দিয়ে মারা হয়েছিল।
সিআইডি অফিসারেরা জানতে চান, বিছুটি পাতা কোথা থেকে আনা হয়েছিল? ক্ষোভে ফেটে পড়ে নির্যাতিতা বলেন, “জঙ্গলের ভিতর থেকেই নিশ্চয়ই আনা হয়েছিল!” এর পরেই তিনি জানান, সিআইডি তদন্তে তাঁর কোনও আস্থা নেই। তাঁর আরও অভিযোগ, “পরে ইলামবাজারের বনভিলা জঙ্গলে আমায় অনেক বেশি মারধর করা হয়েছে। পুলিশের সঙ্গে তৃণমূলের লোকজনও ছিল।” স্থানীয় কয়েক জন তৃণমূল কর্মী-সমর্থকের নামও করেন তিনি। তৃণমূলের বর্ধমান জেলা (শিল্পাঞ্চল) অন্যতম সম্পাদক তথা জেলা পরিষদ সদস্য দেবদাস বক্সীর দাবি, “বিজেপি চক্রান্ত করে আমাদের দলের নাম জড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে।” সিআইডি অফিসারদের দাবি, নির্যাতিতা এর আগে কখনও বনভিলা জঙ্গলের কথা বলেননি।
জঙ্গল থেকে বেরিয়ে নির্যাতিতাকে সঙ্গে নিয়ে তাঁর বাপের বাড়িতে যান তদন্তকারীরা। সিআইডি সূত্রের দাবি, ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে বধূটি যে বয়ান দিয়েছিলেন তার সঙ্গে তাঁর এ দিনের বক্তব্যে কিছু ফারাক রয়েছে। এক সিআইডি কর্তা যোগ করেন, “ঘটনার আকস্মিকতায় বিহ্বল হয়ে অনেকেই সব ঠিকঠাক বলতে পারেন না। সব দিক বিবেচনা করেই তদন্ত এগোবে।” বধূটির বাবা-মায়ের সঙ্গেও কথা বলে সিআইডি। তাঁরা পরে বলেন, “তদন্ত হচ্ছে শুনছি, অথচ এক জন অভিযুক্তও গ্রেফতার হয়নি। আমরা হতাশ।”