স্বামীর হয়ে ভোটের প্রচারে নেমে রাজনীতির পাঠ নেন মমতাবালা

মে মাসের চাঁদিফাটা রোদে প্রচারে বেরিয়ে তখন প্রাণান্ত অবস্থা দলের নেতা-কর্মীদের। খোদ প্রার্থীও কপালের ঘাম মুছতে মুছতে অতিষ্ঠ হচ্ছেন। ভোটারদের দিকে তাকিয়ে হাসছেন বটে। কিন্তু মনে হচ্ছে, বেজায় ধকল কোনও মতে সামলে বেরোচ্ছে সেই হাসি। প্রার্থীর গিন্নি কিন্তু তখনও দিব্যি চাঙ্গা। স্বামীর সঙ্গে মাঝে মধ্যে বেরোচ্ছেন প্রচারে। স্বামী না থাকলেও বেশির ভাগ সময়ে একাই লোকলস্কর নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন বাড়ি বাড়ি। কানাঘুষো শোনা যেত, “এনার্জি দেখলে তো মনে হবে ইনিই ভোটে দাঁড়িয়েছেন!”

Advertisement

সীমান্ত মৈত্র

গাইঘাটা শেষ আপডেট: ১৬ জানুয়ারি ২০১৫ ০৩:১৪
Share:

মে মাসের চাঁদিফাটা রোদে প্রচারে বেরিয়ে তখন প্রাণান্ত অবস্থা দলের নেতা-কর্মীদের। খোদ প্রার্থীও কপালের ঘাম মুছতে মুছতে অতিষ্ঠ হচ্ছেন। ভোটারদের দিকে তাকিয়ে হাসছেন বটে। কিন্তু মনে হচ্ছে, বেজায় ধকল কোনও মতে সামলে বেরোচ্ছে সেই হাসি।

Advertisement

প্রার্থীর গিন্নি কিন্তু তখনও দিব্যি চাঙ্গা। স্বামীর সঙ্গে মাঝে মধ্যে বেরোচ্ছেন প্রচারে। স্বামী না থাকলেও বেশির ভাগ সময়ে একাই লোকলস্কর নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন বাড়ি বাড়ি। কানাঘুষো শোনা যেত, “এনার্জি দেখলে তো মনে হবে ইনিই ভোটে দাঁড়িয়েছেন!”

কয়েক মাসের মধ্যে সেই কানাঘুষোটাই যে সত্যি হয়ে দাঁড়াবে, তা অবশ্য তখন নিজেও অনুমান করতে পারেননি মমতাবালা ঠাকুর। তাঁর স্বামী কপিলকৃষ্ণের হয়ে বনগাঁ লোকসভা কেন্দ্রের প্রচারে বেরিয়ে রাজনৈতিক হাতেখড়ি হয়েছিল সবে। স্বামীর মৃত্যুতে আসন্ন উপনির্বাচনে তিনি যে বিরোধী শিবিরকে বেশ বেগ দিতে তৈরি, সে কথা মনে করছেন বিরোধীরাও।

Advertisement

১৯৮৫ সালে কপিলের দ্বিতীয় স্ত্রী হিসাবে সুদূর মহারাষ্ট্র থেকে ঠাকুরনগরে প্রথম পা রেখেছিলেন মমতাবালা। মরাঠা আবহেই বড় হয়েছেন মমতা। বাড়ি সেই রাজ্যের চন্দ্রপুরায়। স্বামীর সঙ্গে বয়সের ফারাক ছিল অনেকটাই। ফলে সংসারের বেশির ভাগ দায়িত্ব নিজের কাঁধেই তুলে নেন মমতাবালা।

একে একে তিন সন্তান হয়। দুই মেয়ের বিয়েও হয়ে গিয়েছে। ছোটটি এখনও লেখাপড়া করছে। বড়মাও থাকেন তাঁর কাছেই। এঁদের নিয়েই আপাতত সংসার বছর সাতচল্লিশের মমতাবালা ঠাকুরের। যাঁকে বৃহস্পতিবার বনগাঁয় উপনির্বাচনে দলের প্রার্থী হিসাবে ঘোষণা করেছে তৃণমূল।

জীবদ্দশায় কপিলবাবুকে বার বারই বলতে শোনা গিয়েছে, “সংসারটা তো মমতাই সামলায়। আমি ও সব কিছু দেখি না।” কিন্তু সংসার সামলানো ছাড়াও যে এই বধূ আরও বড় ভূমিকাও সামলাতে জানেন, তা প্রকাশ পেয়েছে ক্রমে ক্রমে। কপিলবাবুর মৃত্যুর পরে দেওর মঞ্জুলকৃষ্ণ ও তাঁর ছেলে সুব্রতর সঙ্গে মমতাবালার মনোমালিন্য আরও বাড়ে। শেষকৃত্যটুকু পর্যন্ত অবশ্য গোটা পরিবার ছিল পাশাপাশি। তারপর থেকেই ফাটল চওড়া হতে হতে রাজ্য রাজনীতিতে বহু চর্চার বিষয় তৈরি করেছে।

কপিলবাবু ছিলেন সারা ভারত মতুয়া মহাসঙ্ঘের সঙ্ঘাধিপতি। তাঁর মৃত্যুর পরে নতুন কমিটি গড়ে সঙ্ঘাধিপতি হন মঞ্জুলকৃষ্ণ। ছেলে সুব্রত হন সাধারণ সম্পাদক। কিন্তু পাল্টা কমিটি গড়ে বসেন মমতাবালা। নিজেই হন সঙ্ঘাধিপতি। এই নিয়ে দুই পরিবারের দূরত্ব বাড়ে। মমতাবালার পিছনে তৃণমূলের জেলা নেতৃত্বের একাংশের প্রচ্ছন্ন সমর্থন ছিল বলে মনে করেন মতুয়া বাড়ির একাংশ।

বস্তুত, ২০০৮ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন ক্রমশ মতুয়া বাড়ির ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠছেন (সারা ভারত মতুয়া মহাসঙ্ঘের সদস্য পদও নেন মমতা), সে সময়ে বড়মা বাদে মঞ্জুলই ছিলেন ঠাকুরবাড়ির প্রধান মুখ। কপিলের সঙ্গে বরং বামেদের যোগাযোগ আছে বলে মনে করতেন অনেকেই। সে কথা কপিল কখনও স্বীকার করেননি ঠিকই, কিন্তু শুরুর দিকে তাঁর সঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তেমন কোনও সখ্য তৈরি হয়নি। যদিও তাঁকেই পরে লোকসভা আসনের টিকিট দেন তৃণমূল নেত্রী। সম্প্রতি বারাসতে যাত্রা উৎসবে এসেছিলেন তিনি। দলের একটি সূত্র জানাচ্ছে, সে সময়ে মঞ্জুল তাঁর কাছে আর্জি জানান, মতুয়া বাড়ির কাউকেই যেন প্রার্থী না করা হয়। কিন্তু মমতা সে কথায় বিশেষ কর্ণপাত করেননি। বরং দিন কয়েক আগে নবান্নে জেলা তৃণমূলের সঙ্গে আলোচনার সময়ে কপিলের প্রশংসা করে বুঝিয়ে দেন, প্রয়াত সাংসদের স্ত্রী মমতাবালার প্রতিও তাঁর প্রচ্ছন্ন সমর্থন আছে। ঘটনাক্রম যে দিকে যাচ্ছিল, তাতে তৃণমূলের টিকিট যে মমলাবালাই পাবেন, তা এক রকম নিশ্চিতই ছিল। সেই মতোই ঘোষণা হয়েছে বৃহস্পতিবার।

মমতাবালা এ দিন বলেন, “আমার মতো অভাগীকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্মরণ করায় আমি কৃতজ্ঞ। ওঁকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। কিন্তু মতুয়া ভক্ত ও মহাসঙ্ঘের সঙ্গে কথা বলেই এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেব।”

জ্যেঠিমার প্রার্থী হওয়াকে অবশ্য এ দিন স্বাগতই জানিয়েছেন সুব্রত ঠাকুর। পাশাপাশি তিনি বলেন, “বিজেপির রাজ্য ও কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব যদি আমাকে যোগ্য মনে করে, তা হলে আমাকে প্রার্থী করবে। সে ক্ষেত্রে রাজনৈতিক লড়াই যেমন হওয়ার কথা, তেমনই হবে।”

সুব্রতর নাম অবশ্য ঘোষণা হয়নি এখনও। কিন্তু তার আগেই বিজেপির একাংশের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। ইতিমধ্যেই বারাসতে বিজেপির রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহের গাড়ি ঘিরে ধরে বিক্ষোভ দেখিয়েছেন বিজেপির কিছু নেতা-কর্মী। প্রার্থী হিসাবে সুব্রতকে একেবারেই চাইছেন না তাঁরা। এ দিন গাইঘাটায় মিছিল করেছে বিজেপির কিছু লোকজন। মিনিট দশেকের জন্য রেল অবরোধও করা হয় ঠাকুরনগরে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন