ক্ষোভ বাড়ছে জঙ্গলমহলে

স্বজনহারারা বঞ্চিতই, মাওবাদীদের চাকরি

নয় নয় করে তিন বছর হয়ে গেল। ঘোষণার মঞ্চে যে প্রতিশ্রুতির উৎপত্তি, বাস্তবের মাটিতে তার নেমে আসা হল না! বছর তিনেক আগে জঙ্গলমহলের এক সভায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘোষণা করেছিলেন, রাজ্যে মাওবাদী সন্ত্রাসপর্বে নিহতদের পরিবারকে চাকরি বা পেনশন দেওয়া হবে।

Advertisement

সোমনাথ চক্রবর্তী ও কিংশুক গুপ্ত

কলকাতা ও ঝাড়গ্রাম শেষ আপডেট: ২৫ নভেম্বর ২০১৫ ০৩:৪১
Share:

মদন মাহাতো, সুভাষকান্তি মাহাতো, ধরণী মাহাতো। পরিবার এখনও জানলই না এঁরা জীবিত না মৃত। — নিজস্ব চিত্র

নয় নয় করে তিন বছর হয়ে গেল। ঘোষণার মঞ্চে যে প্রতিশ্রুতির উৎপত্তি, বাস্তবের মাটিতে তার নেমে আসা হল না!

Advertisement

বছর তিনেক আগে জঙ্গলমহলের এক সভায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘোষণা করেছিলেন, রাজ্যে মাওবাদী সন্ত্রাসপর্বে নিহতদের পরিবারকে চাকরি বা পেনশন দেওয়া হবে। কার্যক্ষেত্রে এখনও তা হয়ে ওঠেনি। প্রতিশ্রুতি যে অধরা, মুখ্যমন্ত্রীকে তা জানাতে ইতিমধ্যে নবান্নে গিয়েছিলেন ভুক্তভোগীরা। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর দেখা পাননি। প্রশাসনের কর্তারা ওঁদের বলেছেন, এলাকার বিধায়কদের সুপারিশপত্র নিয়ে এলে মুখ্যমন্ত্রীকে এ ব্যাপারে অবহিত করা হবে।

নবান্ন এ ভাবে ফিরিয়ে দেওয়ায় মন্মথ মাহাতো, জগদীশ মাহাতো, হরিপদ মাহাতো, ইন্দ্রাণী মাইতিরা শুধু ক্ষুব্ধ নয়, ব্যথিতও। ওঁদের প্রত্যেকের পরিবারের কেউ না কেউ মাওবাদীদের হাতে প্রাণ হারিয়েছেন কিংবা কারও হদিস নেই। ঝাড়গ্রাম থানার বলদডুবা গ্রামের ওই সব বাসিন্দার মনোবেদনা কয়েক গুণ বাড়িয়েছে রাজ্য সরকারের আত্মসমর্পণ-পুনর্বাসন সংক্রান্ত নয়া নীতি। কী রকম?

Advertisement

গ্রেফতার হয়ে জামিনে ছাড়া পেয়েছে যে সব মাওবাদী ও লিঙ্কম্যান, রাজ্য সরকার এ বার তাদেরও হোমগার্ডের চাকরি দেবে। সঙ্গে দু’লক্ষ টাকার স্থায়ী আমানত, এককালীন ৫০ হাজার টাকা অনুদান ও ফি মাসে চার হাজার টাকা আর্থিক সাহায্য। বস্তুত আজ, বুধবারই মেদিনীপুরে এক অনুষ্ঠানে জঙ্গলমহলের তিন জেলার এমন ৮৬ জনের হাতে (ঝাড়গ্রাম পুলিশ জেলার ৪৯, পশ্চিম মেদিনীপুর পুলিশ জেলার ১, পুরুলিয়ার ২৫ ও বাঁকুড়ার ১১ জন) ‘প্যাকেজের’ নথিপত্র তুলে দেবেন আইজি (পশ্চিমাঞ্চল) সিদ্ধিনাথ গুপ্ত।

এমতাবস্থায় রাজ্যের বিরুদ্ধে পক্ষপাতের অভিযোগ তুলে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলির প্রশ্ন, ‘‘ধৃত মাওবাদী ও তাদের লিঙ্কম্যানরাও যেখানে সরকারি চাকরি ও আর্থিক প্যাকেজ পাচ্ছে, সেখানে আমরা কেন বঞ্চিত?’’ মন্মথরা জানাচ্ছেন, মুখ্যন্ত্রীকে সামনে পেলে তাঁরা একটা কথাই শুধোবেন— খুনি ও তাদের শাগরেদদের পাশে সরকার দাঁড়াচ্ছে। অথচ যাঁরা খুন হলেন, তাঁদের পরিবারের কথা কেন ভাবছে না?

নবান্নের কী বক্তব্য? স্বরাষ্ট্র দফতর সূত্রের দাবি, মাওবাদী হামলায় নিহতদের পরিবারের জন্য আর্থিক ক্ষতিপূরণের প্যাকেজ রয়েছে। প্রতিটি পরিবার তা পেয়েছে। তবে চাকরি বা পেনশনের কোনও সরকারি সিদ্ধান্তের কথা নবান্নের কর্তারা মনে করতে পারছেন না। অন্য দিকে মন্মথ-ইন্দ্রাণীদের বক্তব্য: বছর তিনেক আগে মুখ্যমন্ত্রী বেলপাহাড়ির প্রশাসনিক জনসভায় স্পষ্ট আশ্বাস দিয়ে গিয়েছিলেন যে, নিহতের পরিবার চাকরি বা পেনশন পাবে। ‘‘সেটা না হলে চলবে কী করে? এই বাজারে ক্ষতিপূরণের চার লাখ (কেন্দ্রের তিন, রাজ্যের এক) টাকায় কী হয়?’’— প্রশ্ন তুলছেন ক্ষতিগ্রস্তেরা।

তাই ‘ন্যায্য’ প্রাপ্য আদায়ের লক্ষ্যে মন্মথ-জগদীশ-হরিপদ-ইন্দ্রাণীর মতো ঝাড়গ্রামের কিছু স্বজনহারা মিলে গড়ে তুলেছেন সংগঠন— ‘মাওবাদী হানায় নিহত পরিবার কল্যাণ সমিতি।’ ওঁরা না হয় জানেন, তাঁদের প্রিয়জন আর দুনিয়ায় নেই। কিন্তু সুভাষকান্তি মাহাতো, মদন মাহাতো বা ধরণী মাহাতোর পরিবারের অবস্থা আরও খারাপ। ওঁরা বেঁচে আছেন কিনা, বাড়ির লোক এখনও তা-ই সরকারি ভাবে জানতে পারেননি! ওঁদের ঘটনাগুলো কী?

ঝাড়গ্রামের লোহামেল্যা গ্রামের বাসিন্দা সুভাষকান্তির পরিজনের অভিযোগ: ২০১০-এর ৩০ অক্টোবর ওঁকে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে
গিয়েছিল জনগণের কমিটির লোকজন। তিনি আর ফেরেননি। ধৃত এক মাওবাদীকে জেরা করে বছর দেড়েক বাদে ঝাড়গ্রামের সিমলির জঙ্গলের মাটি খুঁড়ে একটি কঙ্কালের হাড়গোড় উদ্ধার হয়, যার দাঁতের গঠন দেখে পরিজনেরা প্রাথমিক ভাবে জানান, সেটি সুভাষবাবুর। ডিএনএ পরীক্ষার জন্য মেদিনীপুর মেডিক্যালে সুভাষবাবুর মা-ভাইয়ের রক্তের নমুনা নেওয়া হয়। সাড়ে তিন বছর কেটে গেলেও তার রিপোর্ট আসেনি, ক্ষতিপূরণের টাকাও মেলেনি।

মদন মাহাতোর ক্ষেত্রেও তা-ই। ঝাড়গ্রামের বাঁকশোল গ্রামের প্রৌঢ়কে পুলিশের চর সন্দেহে মাওবাদীরা বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল পাঁচ বছর আগে। বছর দেড়েক বাদে বৈদ্যনাথডিহির কাজুবাগানের মাটি খুঁড়ে একটা কঙ্কাল পাওয়া যায়, যার পোশাকের অবশেষ দেখে মদনবাবুর পরিবার সেটি শনাক্ত করে। স্ত্রী-পুত্রের রক্তের নমুনা নেওয়া হয়। তিন বছরেও ডিএনএ-রিপোর্ট আসেনি, ক্ষতিপূরণ দূর অস্ত্‌। ঘৃতখাম গ্রামের ধরণী মাহাতোর তো কঙ্কালও পাওয়া যায়নি! ছ’বছর আগের এক বিকেলে মাওবাদীদের তলব পেয়ে তাদের শিরষি জঙ্গলের ডেরায় গিয়েছিলেন তিনি। আজও ফিরে আসেননি।

নিহতদের মতো নিরুদ্দেশ এই মানুষগুলির পরিজনও অথৈ জলে। সন্তানদের পড়াশুনোর পাট চুকেছে। রোজকার অন্ন সংস্থান হওয়াই দায়।

নবান্ন কি শুনছে?

মাওবাদী হানায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলির এ হেন দুর্দশার কথা প্রশাসনের আধিকারিকেরা অবশ্য উড়িয়ে দিচ্ছেন না। যদিও তাঁরা অসহায়। ‘‘আমাদের সমবেদনা রয়েছে। তবে সরকারি নীতি না- বদলালে তো কিছু করার নেই। আমাদের হাত-পা বাঁধা।’’— বলছেন এক স্বরাষ্ট্র-কর্তা। কিন্তু ডিএনএ-রিপোর্টে এত দেরি কেন?

ঝাড়গ্রামের ভারপ্রাপ্ত পুলিশ সুপার ভারতী ঘোষ মঙ্গলবার বলেন, “তাড়াতাড়ি রিপোর্ট দিতে সংশ্লিষ্ট বিভাগে চিঠি লিখেছি। কিছু ক্ষেত্রে নমুনা না-পাওয়ায় ফের স্যাম্পল পাঠানো হয়েছে। প্রাণপণ চেষ্টা করছি, যাতে পরিবারগুলো সরকারি নিয়ম অনুযায়ী সাহায্য পায়।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন