সুশীল পালের খুনে ১৩ অভিযুক্তই দোষী সাব্যস্ত

মাঝে কেটে গেল দশ-দশটা বছর। বাড়ি থেকে বেরিয়ে নিখোঁজ হওয়ার পরে দেহ মিলেছিল খালে। তদন্তে বলা হয়েছিল, অবৈধ গর্ভপাত করতে না-চাওয়ায় খুন করা হয় শ্রীরামপুর ওয়ালশ হাসপাতালের চিকিৎসক সুশীল পালকে। দশ বছর পরে সেই মামলায় সোমবার অভিযুক্ত ১৩ জনকেই দোষী সাব্যস্ত করল আদালত। হাওড়া জেলা জজ তন্ময় গুপ্তের ওই রায়ের পরে আজ, মঙ্গলবার শাস্তি ঘোষণা করা হবে।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ২২ এপ্রিল ২০১৪ ০৩:৩৪
Share:

দুই কন্যা শ্রেয়া ও শ্রীজার সঙ্গে সুশীল পালের স্ত্রী কণিকা পাল। সোমবার, হাওড়া আদালতের বাইরে। —নিজস্ব চিত্র

মাঝে কেটে গেল দশ-দশটা বছর।

Advertisement

বাড়ি থেকে বেরিয়ে নিখোঁজ হওয়ার পরে দেহ মিলেছিল খালে। তদন্তে বলা হয়েছিল, অবৈধ গর্ভপাত করতে না-চাওয়ায় খুন করা হয় শ্রীরামপুর ওয়ালশ হাসপাতালের চিকিৎসক সুশীল পালকে। দশ বছর পরে সেই মামলায় সোমবার অভিযুক্ত ১৩ জনকেই দোষী সাব্যস্ত করল আদালত। হাওড়া জেলা জজ তন্ময় গুপ্তের ওই রায়ের পরে আজ, মঙ্গলবার শাস্তি ঘোষণা করা হবে।

সিআইডি জানায়, ২০০৪ সালের ২ জুলাই সুশীল পাল তাঁর ব্রড স্ট্রিটের বাড়ি থেকে বেরিয়ে নিখোঁজ হন। পরদিন হাওড়ার সাঁকরাইল থানার রাজগঞ্জে গঙ্গার সঙ্গে সংযোগকারী একটি খালে তাঁর দেহ মেলে। তদন্তে নেমে সিআইডি জানায়, হাওড়ার বালির এক নার্সিংহোমে অবৈধ গর্ভপাত করতে না-চাওয়ায় খুন হন সুশীলবাবু। সিআইডি-র অভিযোগ ছিল, ওই নার্সিংহোমের সঙ্গে যুক্ত এক মহিলা চিকিৎসকের গর্ভপাত করাতে চাপ দেওয়া হয়েছিল সুশীলবাবুকে। তা করতে রাজি না হওয়ায় পরিকল্পিত ভাবে তাঁকে খুন করা হয়।

Advertisement

কিন্তু প্রায় এক দশক পরে এ দিন সরকার পক্ষের আইনজীবী সন্দীপ ভট্টাচার্য বলেন, “কী কারণে চিকিৎসক সুশীল পালকে খুন করা হল, তদন্তে তা পরিষ্কার হয়নি।” যদিও ওই আইনজীবীর দাবি, “ষড়যন্ত্র করেই সুশীল পালকে খুন করা হয়েছে। পারিপার্শ্বিক তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে মামলা দায়ের করা হয়।”

সবিস্তার...

খুনের ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে বালি-বেলুড়-লিলুয়া এলাকায় সিপিএমের আঞ্চলিক কমিটির তৎকালীন সদস্য বিশ্বজ্যোতি বসু, পিয়ালি দাস মণ্ডল-সহ ১৩ জনকে গ্রেফতার করে সিআইডি। গ্রেফতারির পরেই দল থেকে বহিষ্কার করা হয় বিশ্বজ্যোতিকে। সিআইডি প্রত্যেকের বিরুদ্ধেই খুন, তথ্যপ্রমাণ লোপাট ও ষড়যন্ত্রের অভিযোগ দায়ের করে। বছর কয়েক আগে কৃষ্ণেন্দু সাধুখাঁ নামে এক অভিযুক্ত মারা যান।

মামলা চলাকালীন বিশ্বজ্যোতি বসু, অমিত বন্দ্যোপাধ্যায়, শুভনারায়ণ ঘোষ, প্রহ্লাদ সরকার এবং সন্তোষ অগ্রবাল জেল-হেফাজতে ছিলেন। জামিনে মুক্ত ছিলেন সিটু-র প্রাক্তন সদস্য জয়ন্ত ঘোষ, রাজীব নাথ, বিশ্বনাথ কংসবণিক, চন্দন ডোম, সুরেন্দ্র অগ্রবাল এবং মুমতাজ আহমেদ খান। এ দিন রায় ঘোষণার পরে বিচারক জামিনে মুক্তদের পুনরায় জেল হেফাজতে রাখার নির্দেশ দেন।

এ দিন জেলা জজ তন্ময় গুপ্ত বিশ্বজ্যোতি, পিয়ালি, অমিত, শুভনারায়ণ, প্রহ্লাদ, সন্তোষ, সুরেন্দ্র ও মুমতাজকে খুন, তথ্যপ্রমাণ লোপাট, ষড়যন্ত্রের দায়ে দোষী সাব্যস্ত করেন। জয়ন্ত, বিশ্বনাথ, রাজীব এবং চন্দনকে তথ্যপ্রমাণ লোপাটের দায়ে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে।

সিআইডি-র বক্তব্য, ওই ঘটনায় ধৃত বিশ্বনাথ কংসবণিক গোপন জবানবন্দিতে জানান, ২০০৪ সালের ২ জুলাই দুপুর ১টা নাগাদ বালির ওই নার্সিংহোমের পাম্পম্যান ও ম্যানেজার অমিত বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অন্য এক কর্মী সাদা রঙের একটি গাড়িতে চাপিয়ে সুশীল পালকে ওই নার্সিংহোমে নিয়ে এসেছিলেন। বিশ্বনাথ ওই সময়ে ছিলেন নার্সিংহোমের কাউন্টারে।

সিআইডি আদালতে জানায়, নার্সিংহোমের পরিচালন সমিতির সম্পাদক বিশ্বজ্যোতি বসু নার্সিংহোমে তাঁর নিজের ঘরে চলে যান। তাঁরা ঢোকার পরে ওই ঘরের দরজা বন্ধ হয়ে যায়। সেখানে চা খাওয়ার পরে বিশ্বজ্যোতি সুশীল পালকে নিয়ে নার্সিংহোমের তিনতলায় অপারেশন থিয়েটারে চলে যান। পুলিশ জানায়, ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে দেওয়া জবানবন্দিতে বিশ্বনাথ বলেন, কিছুক্ষণ পরে তিনতলা থেকে চেঁচামেচির আওয়াজ মেলে। সেই সময়ে নার্সিংহোমের চিকিৎসক পিয়ালি দাস মণ্ডলও তিনতলায় হাজির ছিলেন বলে বিশ্বনাথ জানান। তিনি জানিয়েছেন, ওই সময়ে বিশ্বজ্যোতি অমিত ও অন্য এক কর্মীকে তিনতলায় ডেকে পাঠান।

সিআইডি জানায়, বিশ্বনাথের জবানবন্দি অনুযায়ী, তিনি তিনতলায় উঠে দেখেন, অমিত, শুভনারায়ণ ও প্রহ্লাদ ধরাধরি করে সুশীল পালের দেহ একটি ট্রলিতে তুলছেন। বিশ্বনাথ জানান, তাঁকে সুশীলবাবুর দেহের উপরে একটি সাদা চাদর ঢাকা দিতে বলেন বিশ্বজ্যোতি বসু। সিআইডি জানায়, তার পরে অমিত মোটরসাইকেলে চেপে বালি খাল এলাকা থেকে একটি অটো ভাড়া করে আনেন। জবানবন্দিতে বিশ্বনাথ জানান, তিনি ও প্রহ্লাদ দু’জনে মিলে সুশীল পালের মৃতদেহটি ওই অটোয় তুলে দিয়েছিলেন। অটোয় সুশীল পালের মৃতদেহ নিয়ে এক দিকে বসেছিলেন অমিত, অন্য দিকে ছিলেন শুভনারায়ণ। পরে সুশীলবাবুর দেহ তোলা হয় অন্য একটি গাড়িতে। কিছু দূর যাওয়ার পরে ফের অন্য একটি গাড়িতে তোলা হয় সুশীলবাবুর দেহ। সেই গাড়িতেই ওই চিকিৎসককে সাঁকরাইলের খালে ফেলে দিয়ে আসা হয় বলে জানিয়েছেন বিশ্বনাথ।

জেলা জজ আগেই ঘোষণা করেছিলেন, এ দিন এই মামলায় রায় দেওয়া হবে। রায় শোনার জন্য দুপুরে জেলা জজের আদালতে ভিড় জমে। বেশি সংখ্যায় ছিলেন বালির লোকজন। দুপুর ২টোয় রায় ঘোষণার সময় নির্দিষ্ট করা থাকলেও, জেলা জজ এজলাসে ওঠেন দুপুর আড়াইটে নাগাদ। জামিনে মুক্ত সাত জনকে কাঠগড়ার সামনে আসতে বলেন বিচারক। তার পরে তিনি জানান, পারিপার্শ্বিক তথ্যপ্রমাণের উপর ভিত্তি করে তিনি অভিযুক্তদের দোষী সাব্যস্ত করছেন।

রায় শুনে এজলাসে চিৎকার করে ওঠেন বিশ্বজ্যোতি। বলেন, “যাঁকে আমি চিনি না, তাঁকে খুনের অপরাধে আমাকে ইতিমধ্যেই ১০ বছর কারাবাস করতে হল। বোঝাই যাচ্ছে, বিচার ব্যবস্থা বিক্রি হয়ে গিয়েছে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন