প্রথমে সরকারি কৌঁসুলি মিলছিল না। মাস দু’য়েক আগে আইনজীবী পাওয়া গেলেও, সোমবার আমতার মুক্তিরচক গণধর্ষণ মামলার সাক্ষ্যগ্রহণের প্রথম দিনেই সরে দাঁড়ালেন তিনি। আমতার অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা আদালতে সরকারি আইনজীবী নন্দ হাজরা বিচারক শ্যামলকুমার রায়চৌধুরীর কাছে লিখিত আবেদনে জানিয়ে দিলেন, ‘অনিবার্য কারণে’ তিনি এই মামলা থেকে সরে যাচ্ছেন। ফলে, ফের ধাক্কা খেল গুরুত্বপূর্ণ মামলাটির শুনানি। বিরক্ত হলেন খোদ বিচারক।
এলাকার ট্রান্সফর্মার থেকে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে গত ৪ ফেব্রুয়ারি রাতে জনা দশেক দুষ্কৃতী মুক্তিরচকের এক বধূ এবং তাঁর জেঠশাশুড়িকে গণধর্ষণ এবং মারধর করে বলে অভিযোগ। আত্মীয়দের দাবি, এই পরিবারটির কয়েক জন বিজেপি-র, কয়েক জন সিপিএমের সঙ্গে যুক্ত। সেই আক্রোশেই ওই হামলা। মামলায় অন্যতম প্রধান অভিযুক্ত হিসেবে স্থানীয় দুই তৃণমূল নেতা বরুণ মাখাল এবং রঞ্জিত মণ্ডল-সহ ৯ জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। বরুণ-সহ ছয় অভিযুক্ত বর্তমানে জামিনে রয়েছে। আদালতে চার্জশিটও দিয়েছে পুলিশ। কিন্তু সরকারি কৌঁসুলির অভাবে যে ভাবে মামলার শুনানি পিছোচ্ছে, তাতে সরকারের ‘সদিচ্ছা’ নিয়ে প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন বিরোধীরা।
আমতার কংগ্রেস বিধায়ক অসিত মিত্র বলেন, “তৃণমূলের লোকেরা এই ঘটনায় জড়িত বলেই বিচার প্রক্রিয়াকে দীর্ঘায়িত করার চেষ্টা করছে সরকার, যাতে নির্যাতিতারা শেষ পর্যন্ত বিচারই না পান।” বিজেপি বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্যের মন্তব্য, “এ রাজ্যের সরকার প্রয়োজন হলে কখনও বিচার ব্যবস্থাকে এড়িয়ে চলে, কখনও মাড়িয়ে চলে।” আইনজীবী তথা সিপিএম নেতা বিকাশ ভট্টাচার্যের বক্তব্য, “সদ্য দায়িত্ব নেওয়া সরকারি কৌঁসুলি মামলার প্রথম দিনে সরে যাবেন, এটা বিশ্বাস করতে পারছি না। অনিবার্য কারণ বলতে শাসক দলের প্রভাব খাটানোর কথাই প্রথম মাথায় আসে।”
বিরোধীদের অভিযোগ মানতে চাননি উলুবেড়িয়া উত্তরের তৃণমূল বিধায়ক নির্মল মাজি। তাঁর দাবি, “দোষীরা যে দলেরই হোক না কেন, তারা যেন দ্রুত সাজা পায়। সরকারি উকিল মামলা থেকে কেন সরে গেলেন, খোঁজ নিয়ে দেখব।” রাজ্যের আইনমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্যের দাবি, “সরকার এই মামলাটাকে গুরুত্ব দিয়ে দেখছে। কিন্তু সরকারি কৌঁসুলি নিয়োগ নিয়ে যে সমস্যা হয়েছে, কেউ সে কথা আমাকে জানাননি। এটা হওয়ার কথা নয়। খোঁজ নিচ্ছি।”
এ দিন আমতার অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা আদালতে মুক্তিরচক গণধর্ষণ মামলা উঠতেই সরকারি আইনজীবী নন্দবাবু বিচারকের কাছে তাঁর সরে যাওয়ার কথা জানান।
বিচারক জানতে চান, “কেন সরে যাচ্ছেন?” নন্দবাবুর উত্তর, “আবেদনপত্রে লিখেছি। অনিবার্য কারণে।” বিচারক: “অনিবার্য কারণটি খুলে বলুন না।’’ নন্দবাবু: “সব কথা সব জায়গায় বলা যাবে না স্যার।”
জবাব শুনে বিচারক বলেন, “মামলা প্রক্রিয়ার সব প্রস্তুতি সম্পূর্ণ। শুধু সরকারি আইনজীবী না থাকায় আমার হাত-পা বাঁধা হয়ে যাচ্ছে। মামলার কাজ এগোচ্ছে না একটুও।”
তিনি হাওড়ার জেলা সরকারি আইনজীবী অরবিন্দ নস্করকে লিখিত নির্দেশ দেন, আগামী ১০ নভেম্বরের মধ্যে এই মামলার সরকারি কৌঁসুলি নিয়োগ করতে। ১১ নভেম্বর মামলার পরবর্তী সাক্ষ্য গ্রহণের দিন ধার্য হয়।
কিন্তু যেখানে শাসক দলের নেতা-কর্মীরাই অভিযুুক্ত, সেখানে ফের দ্রুত সরকারি আইনজীবী নিয়োগ হবে কি না, তা নিয়ে ধন্দ রয়েছে অনেকের। কারণ, মামলাটি সাক্ষ্যগ্রহণ পর্যন্ত পৌঁছনোর আগে অনেক পর্ব গিয়েছে। উলুবেড়িয়া এসিজেএম আদালত থেকে মামলাটি এই আদালতের দায়রা বিচারকের কাছে পাঠানো হয় গত ২ জুলাই। সেখান থেকে মামলাটি যায় আমতা আদালতের অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা বিচারকের কাছে। কিন্তু সরকারি আইনজীবী নিয়োগ না হওয়ায় শুনানি পিছোতে থাকে। শেষ পর্যন্ত অরবিন্দ নস্কর নন্দবাবুকে এই মামলার সরকারি কৌঁসুলি হিসাবে নিয়োগ করেন। গত ১৪ সেপ্টেম্বর অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে চার্জগঠন করা হয়। ওই দিনই ঠিক হয় ৩, ৫, ৭, ১০, ১১, ১২, ১৩, ১৪ এবং ১৫ নভেম্বর পর্যন্ত টানা সাক্ষ্যগ্রহণ হবে। কিন্তু শুরুতেই ধাক্কা খেল সাক্ষ্যগ্রহণ।
কেন সরে দাঁড়ালেন? নন্দবাবু ফের বলেন, “সব কথা সব জায়গায় বলা যাবে না।” জেলা সরকারি আইনজীবী অরবিন্দ নস্কর বলেন, “আমার-ই বা কী করার আছে! আশা করছি, বিচারকের নির্দেশ মতো দ্রুত নতুন সরকারি আইনজীবী ঠিক করে ফেলতে পারব।”
কিন্তু সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু না হওয়ায় হতাশ মুক্তিরচকের নির্যাতিতাদের পরিবার। এ দিন নির্যাতিতা অল্পবয়সী বধূটির স্বামী বলেন, “যে ভাবে হোক মামলাটি দেরি করিয়ে দেওয়ার জন্য বিশেষ একটি মহল যেন উঠে পড়ে লেগেছে!” নির্যাতিতাদের পক্ষের আইনজীবী রেজাউল করিম বলেন, “সরকারি কৌঁসুলি না থাকলে আমি-ই বা কী করব?”
তবে বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের অনেকে মনে করছেন, তৃণমূলের নেতা-কর্মীরাই মামলায় অভিযুক্ত হওয়ায় এই মামলায় সরকারি কৌঁসুলি হওয়াটা অস্বস্তিকর ঠেকতে পারে আইনজীবীদের কাছে। তাঁদের মতে, সাম্প্রতিক অতীতে নানা মামলায় ব্যক্তিগত মত উপেক্ষা করে সরকারি কৌঁসুলিকে কার্যত শাসক দলের ‘অঙ্গুলিহেলনে’ চলতে হয়েছে। তাঁরা মনে করিয়ে দিচ্ছেনলোকসভা ভোটের সময়ে বুথে ঢুকে ভোটকর্মীদের মারধর ও ছাপ্পা ভোট দেওয়ায় অভিযুক্ত সোনামুখীর তৃণমূল বিধায়ক দীপালি সাহার জামিনের বিরোধিতা করেননি সরকারি কৌঁসুলি। বোলপুর থানায় ঢুকে পুলিশ পেটানোয় অভিযুক্ত যুব তৃণমূল নেতা (এখন বহিস্কৃত) সুদীপ্ত ঘোষের আগাম জামিনের আবেদনেরও বিরোধিতা করতে দেখা যায়নি সরকারি কৌঁসুলিকে।
অনেকে মনে করাচ্ছেন সুচপুর মামলা-র প্রসঙ্গ। ২০০০ সালের ২৭ জুলাই বীরভূমের সুচপুরে খুন হন ১১ জন খেতমজুর। নিহতেরা তাদের কর্মী-সমর্থক বলে দাবি করে তৃণমূল। ১৬ বার পিছনোর পর ২০০৫-এর সেপ্টেম্বরে সিউড়ি আদালতে মামলার শুনানি শুরু হয়। মামলার সরকারি আইনজীবীর বিরুদ্ধে সিপিএমের হয়ে পক্ষপাত এবং শুনানিতে দেরি করিয়ে দেওয়ার অভিযোগ তুলেছিল তৃণমূল। এর জেরে সরকারি আইনজীবীকে বদল করে যাঁকে দায়িত্ব দেওয়া হয়, তিনিও নানা সময়ে কলকাতা হাইকোর্টে মামলা রয়েছে জানিয়ে গরহাজির থাকতেন। সে জন্যও শুনানিতে দেরি হয়েছিল বলে অভিযোগ ছিল তৃণমূলের। সেই সূত্র ধরে বিজেপি-র এক রাজ্য নেতার টিপ্পনী, “যে যায় লঙ্কায়...!”