অন্য সব ক’টা অভিযানের মতোই ক্রমশ কঠিন থেকে কঠিন হয়ে উঠছিল শেষটা। আর একটা পা, আরও একটা, আর কয়েকটা.... এই করে করেই যখন কাঞ্চনজঙ্ঘা শৃঙ্গে পৌঁছলাম, তখন ঘড়ি বলছে কাঁটায় কাঁটায় সকাল দশটা। ঠিক শৃঙ্গ নয়, তার কয়েক ফুট নীচে। সামিট বলে পরিচিত যে জায়গাটা।
ঝকঝকে রোদ, চোখ ধাঁধানো। প্রথমেই সুন্দর আবহাওয়ার জন্য প্রকৃতিকে ধন্যবাদ জানিয়ে বের করলাম ক্যামেরাটা। হাওয়ায় শরীর ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছিল। টুসিকে দেখতে পেলাম, এসে গিয়েছে প্রায়। তখন ১০টা ৩৫। তার পরেই ১১টার সময় এসে পৌঁছল ছন্দা, কয়েক মিনিটের মাথায় রাজীবও। স্বাভাবিক ভাবেই খুব ভাল লাগছিল। বাংলার চার জন একসঙ্গে কাঞ্চনজঙ্ঘায় পা রেখেছি। ছন্দা আর টুসির আনন্দটা তো আরওই স্পেশ্যাল। রুকস্যাক নামিয়ে এ বার একটু জিরোনোর পালা। অভ্যাসমতো ছবিও তুলে চলেছি একটানা।
কিন্তু দীর্ঘ পথ ফিরতেও তো হবে। একটু পরেই নামতে শুরু করলাম। অন্য সব অভিযানের মতোই, ভীষণ অবসন্ন হয়ে আসছিল শরীর-মন। পুরনো অভিজ্ঞতা থেকে জানি, কতটা সতর্ক থাকতে হয় এই নামার সময়টা। শুধু ক্লান্তির জন্যই ঘটে যেতে পারে দুর্ঘটনা। আর কাঞ্চনজঙ্ঘার সামিট ক্যাম্প থেকে সামিটের লম্বা পথ তো অন্য যে কোনও অভিযানের চেয়ে অনেক অনেক গুণ বেশি কঠিন।
দুপুর, বিকেল গড়িয়ে সন্ধে। শেষের দিকটা অসুবিধা হচ্ছিল আমার ক্যামেরাটার জন্য। শেরপা পাসাংকে ক্যামেরাটা রুকস্যাকে ঢুকিয়ে দিতে বললাম। পাসাং বলল, “এখন এখানে দাঁড়িয়ে স্যাক খুলে ক্যামেরা ঢোকানো মুশকিল। “আমায় দাও, গলায় ঝুলিয়ে নিচ্ছি।” তা-ই করলাম। সামিট ক্যাম্পে প্রায় চলেই এসেছি আমি আর ছন্দা। হঠাৎ আমাদের পিছনে হুড়মুড় করে একটা ফল করল টুসি। ফল অ্যারেস্টও করল। আমার সঙ্গে থাকা পাসাং দৌড়ে গেল ওর কাছে, ওকে দাঁড় করালো। আমরা এগোলাম ক্যাম্পের দিকে।
সামিট ক্যাম্পের একদম কাছাকাছি, ছন্দা বলল “হাতটা একটু ধরো তো দীপঙ্করদা, পারছি না আর।” অতটা রাস্তা যাওয়া-আসা, না পারাই স্বাভাবিক। ওকে ধরে তাঁবুতে ঢুকিয়ে দিলাম। তখন সন্ধে সাড়ে সাতটা। খানিক পরেই রাজীব আর টুসিকে নিয়ে পৌঁছল পাসাং। কিন্তু আমার ক্যামেরা! কাঁচুমাচু মুখে পাসাং জানাল, টুসিকে ওঠানোর সময় কী করে যেন গলা থেকে খুলে পড়ে গিয়েছে ক্যামেরাটা। হৃৎপিণ্ডটা যেন থেমে গিয়েছিল। ওটাতে তো অভিযানের সব ছবি আছে! পাসাংকে নিয়ে তখনই আবার বেরোতে চেয়েছিলাম ক্যামেরা খুঁজতে। পাসাং জোর করে আটকে বলল, “কাল সকালে গিয়ে দেখব।”
অনেকটা ভাগ্যের জোর ছিল, তাই পরের দিন, মানে সোমবার সকালে আমি আর পাসাং গিয়ে খুঁজেও পেলাম ক্যামেরাটা। লেন্স ভেঙে গিয়েছিল। কিন্তু মেমরি কার্ডটা অক্ষতই ছিল।
এ সব করে যখন সামিট ক্যাম্পে ফিরলাম তখন ১১টা বাজে। পাহাড়ের হিসেবে বেশ বেলাই। টুসি দু’জন শেরপাকে নিয়ে নামতে শুরু করে দিয়েছে আগেই। কিন্তু রাজীব আর ছন্দা নামেনি কেন এখনও? জানলাম ওরা ইয়ালুং কাং, মানে কাঞ্চনজঙ্ঘার পশ্চিম শৃঙ্গ সামিট করার চেষ্টা করবে সেই রাতেই। বোঝানোর চেষ্টা করেছিলাম, এতটা ক্লান্তির পর ব্যাপারটা কার্যত অসম্ভব। কিন্তু খুব বেশি কিছু বলারও ছিল না, কারণ রাজীব আর ছন্দা সে রকমই পরিকল্পনা করে এসেছিল।
সময় নষ্ট না করে নামতে শুরু করি আমি। রাতের মধ্যে পৌঁছলাম বেসক্যাম্পে। মঙ্গলবার সারা দিন দুশ্চিন্তা ছিল ছন্দাদের জন্য। মঙ্গলবারই অনেকটা বেশি রাতে ফিরে এসেছিল রাজীব। ইয়ালুং কাং-এর কঠিন পথে এগোনোর সাহস পায়নি ও। এ সবই অবশ্য পরে অন্যদের মুখে
শোনা, কারণ রাজীব ফেরার সময়ে আমি ঘুমোচ্ছিলাম। পরের দিন ভোরেই বেসক্যাম্প ছেড়ে বেরিয়ে পড়ি। আর তখনই শুনেছিলাম, ছন্দা একাই তিন শেরপাকে নিয়ে ওপরে থেকে গিয়েছে। এটা ভেবে আরও বেড়েছিল দুশ্চিন্তা। কিন্তু বেসক্যাম্পে আর বসে থাকার উপায়ও ছিল না আমার। তবে আমি নেমে এলেও রাজীব থেকে গিয়েছিল, ছন্দা ফিরলে ওর সঙ্গে নামবে বলে।
বুধবার ভোর ছ’টা নাগাদ বেসক্যাম্প ছাড়লাম আমি আর টুসি। স্পেনের অভিযাত্রীদের একটা দল ছিল, তাঁরাও বুধবার নামতে শুরু করলেন। কয়েক জন শেরপা রয়ে গেলেন ওই দলটার জিনিসপত্র সব গুছিয়ে নামানোর জন্য। নামার পথে আবহাওয়া খুব একটা ভাল ছিল না। ছন্দাদের জন্য ভীষণ চিন্তা হচ্ছিল।
শুক্রবার দেখা হয়ে গেল স্পেনের ওই দলের শেরপাদের সঙ্গে। মনে হল বড্ড তাড়াতাড়ি যেন নেমে এসেছেন ওঁরা। শেরপাদের ক্ষেত্রে এটা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু কেন জানি না মনে হল, কিছু একটা ঘটেছে। ওঁদের মুখগুলোতেও উদ্বেগের ছাপ। ছন্দার কথা মনে পড়তেই বুকটা কেঁপে উঠল। নামার সময় বলেছিল, “হাতটা একটু ধরো তো...”
শেরপাদের মুখ থেকেই শুনলাম সব। বুধবার বেলা দশটা নাগাদ তাশি ফিরেছিল বেসক্যাম্পে। জানিয়েছিল, মঙ্গলবার সকালে ইয়ালুং কাং-এর সামিটের কাছে তুষারধসের মুখে পড়েছিল ছন্দারা। খোঁজ নেই। ওর সঙ্গেই হারিয়ে গিয়েছে দাওয়া আর মিংমা পেমবাও। ভোরে আমরা নামতে শুরু করার কয়েক ঘণ্টা পরেই এই খবর পেয়ে বদলে গিয়েছিল বেসক্যাম্পের ছবিটা।
পুরো ঘটনাটা শুনতে, বুঝতে, বিশ্বাস করতে বেশ খানিকটা সময় লেগেছিল। মনে হয়েছিল, আর কয়েক ঘণ্টা বেসক্যাম্পে থেকে গেলে হতো। কিছু করতে পারতাম কি না জানি না, কিন্তু অস্থির লাগছিল খুব। রাগও হচ্ছিল। কথা শুনল না মেয়েটা কিছুতেই। এত জেদ... এ ভাবে দাম দিতে হল। আরও অনেক পাহাড় তো বাকি ছিল। পুরো পৃথিবীটাই পড়ে ছিল ওর জন্য। বরফরাজ্যে হারিয়ে যাওয়ার কথা তো ছিল না।
অনুলিখন: তিয়াষ মুখোপাধ্যায়