সৌদি আরবের বোমাবর্ষণের পর জ্বলছে অস্ত্রাগার। শনিবার ইয়েমেনের আডেনে। ছবি: এএফপি।
রাতভর তীব্র বোমাবর্ষণের আওয়াজ। সকালে খবর মিলল, শিয়া হুথি জঙ্গিদের দখলে থাকা অস্ত্রাগার গুঁড়িয়ে দিয়েছে সৌদি আরবের যুদ্ধবিমান। ইয়েমেনের রাজধানী সানায় তার পর থেকে শ্মশান-স্তব্ধতা। তার মধ্যেই সে দেশে আটকে পড়া ভারতীয়দের ফেরানোর কাজ শুরু করল নয়াদিল্লি। বিদেশ মন্ত্রক জানিয়েছে, আজ সানা থেকে ইয়মেনি বিমান সংস্থার প্রথম যে উড়ান ছাড়বে তাতেই ৮০ জন ভারতীয়কে প্রতিবেশী দেশ জিবুতিতে আনা হচ্ছে। সেখান থেকে তাঁদের দেশে ফেরানোর ব্যবস্থা করবে ভারতীয় দূতাবাস। গত কয়েক দিন ইয়েমেনের বিমানবন্দর বন্ধ ছিল। তাই ভারতীয়দের জলপথে জিবুতিতে এনে তার পরে উড়ানে ভারতে আনার কথা ভেবেছিল বিদেশ মন্ত্রক। কিন্তু ইয়েমেনি বিমান সংস্থার উড়ান চালু হওয়ায় উদ্ধারকার্যে কিছুটা সুবিধে হল বলে মনে করা হচ্ছে। তবে উদ্ধারকার্যের জন্য আজ দু’টি ভারতীয় জাহাজও ওই অঞ্চলের দিকে রওনা হয়েছে। সেগুলি পৌঁছতে পাঁচ দিন লাগার কথা।
পাশাপাশি ইয়েমেনে কর্মরত কেরলের নার্সদের পাসপোর্ট সমস্যা সমাধানেও উদ্যোগী হয়েছে ভারতীয় দূতাবাস। গত কাল কেরলের মুখ্যমন্ত্রী উমেন চান্ডি জানতে পেরেছিলেন, ওই নার্সদের পাসপোর্ট ও শংসাপত্র তাঁদের নিয়োগকারী হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের হেফাজতে রয়েছে। যা না মিললে তাঁদের দেশে ফেরানোয় বাধা তৈরি হতে পারে। এখন ইয়েমেনের যা অবস্থা, তাতে পাসপোর্ট-শংসাপত্র নার্সরা ফেরত নাও পেতে পারেন বলে আশঙ্কা তৈরির ।
বিষয়টি গতকালই বিদেশ মন্ত্রককে জানান চান্ডি। পাসপোর্ট সমস্যা সমাধানে ইয়েমেনের ভারতীয় দূতাবাসকে এগিয়ে আসতে অনুরোধ করেন। তার পরই তৎপরতা বাড়িয়েছে দূতাবাস। এক সরকারি বিবৃতিতে বলা হয়েছে, যদি কোনও কারণে ওই নার্সরা পাসপোর্ট হাতে না পান সে ক্ষেত্রে দূতাবাস তাঁদের বিশেষ ধরনের ‘এক্সিট পাস’ দেওয়ার ব্যবস্থা করবে। তা নিয়ে দেশে ফিরতে পারবেন নার্সরা। পরে তাঁদের নতুন পাসপোর্ট দেওয়া হবে। ইয়েমেনের সংস্থা থেকে প্রাপ্য বেতন যাতে তাঁরা পান, সেটাও দেখবে দূতাবাস। তবে এত চিন্তার মাঝে একটাই আশার খবর। তা হল, এখনও পর্যন্ত ওই ভারতীয়দের প্রত্যেকে সম্পূর্ণ নিরাপদে রয়েছেন।
রাষ্ট্রপুঞ্জও ইয়েমেন থেকে তাদের ২০০ জন কর্মীকে সরিয়ে নিয়েছে। গত তিন ধরে ইয়েমেনের অবস্থার দ্রুত অবনতি হয়েছে। বিশেষত গত কাল সারা রাত ধরে সানায় বোমাবর্ষণ করেছে সৌদি আরবের যুদ্ধবিমান। মূলত শিয়া হুথি সম্প্রদায়ের অস্ত্রাগার ও বিভিন্ন যুদ্ধ সরঞ্জাম রাখার জায়গাই ছিল সে হামলার লক্ষ্য। সানার এক বাসিন্দার বয়ানে, “গত তিন দিনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বোমাবর্ষণ হয়েছে গতকাল। থেকে থেকে কেঁপে উঠেছে ঘর, বাড়ি, জানলা, দরজা।” আর এক জনের বয়ানে, “রাতে যত বার বিমানগুলি আমার বাড়ির উপর দিয়ে উড়ে দিয়ে গিয়েছে, তত বার আমার ছেলেমেয়েরা খাটের তলায় লুকিয়েছে। কখনও বোমাবর্ষণের আওয়াজে চিৎকার করে উঠেছে, কখনও আবার কেঁদেছে।” সানার মতোই ভয়ানক পরিস্থিতি হয়েছে ইয়েমেনের দক্ষিণে অন্যতম শহর আডেনে। সেটি দখল করার জন্য এ দিন সকাল থেকেই তৎপর ছিল ইয়েমেনের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট আলি আবদুল্লা সালের অনুগত শিয়া হুথি জঙ্গিরা। তাদের থামাতে বর্তমান প্রেসিডেন্ট আবেদাব্বো মনসুর হাদির অনুগত সুন্নি যোদ্ধাদের সমর্থনে ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে এসেছে সৌদি আরবের যুদ্ধবিমান। চলেছে প্রবল বোমাবর্ষণ। অবশ্য এটাই প্রথম নয়। গত তিন দিন ধরেই আডেন দখলের জন্য শিয়া হুথি সম্প্রদায়ের সঙ্গে তীব্র লড়াই হচ্ছে হাদির অনুগত সুন্নিদের। তাতে ৬১ জনের প্রাণ গিয়েছে বলে খবর।
এর পরও সৌদি আরব অবশ্য থামার কথা ভাবছে না। বরং যত দিন না পর্যন্ত ইয়েমেনে শান্তি ফিরছে, তারা এই ভাবেই হাদি-সরকারের সমর্থনে লড়াই জারি রাখবে বলে জানিয়েছে। এ কাজে তাদের পাশে রয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরশাহি-সহ আরব দুনিয়ার আরও বেশ কিছু দেশ।
এই লড়াইয়ে সৌদি আরবকে সাহায্য করছে আমেরিকা। আজ দুই সৌদি যুদ্ধবিমান চালককে লোহিত সাগর থেকে উদ্ধার করেছে মার্কিন নৌসেনা। সৌদি আরবকে লড়াইয়ে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। বার বার অভিযোগ উঠেছে, সালের অনুগত শিয়া হুথি সম্প্রদায়ের জঙ্গিদের মদত দেয় ইরান। এত দিন সেই অভিযোগ নিয়ে ইরান কিছু না বললেও এ দিন মুখ খুলেছে। ইয়েমেনের বিষয়ে সৌদি আরবের এত তৎপরতা যে মোটেও সমর্থন করছে না তারা, তা দিন স্পষ্ট বুঝিয়ে দিয়েছে তেহরান। তবে সালে নিজে এ দিন যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছেন। তাঁর ইচ্ছা, রাষ্ট্রপুঞ্জে কিংবা সংযুক্ত আরব আমিরশাহির কোথাও বিষয়টি নিয়ে আলোচনায় বসুক শিয়া হুথি সম্প্রদায় ও হাদি সমর্থক সুন্নি সম্প্রদায়ের কর্তাব্যক্তিরা।
তাতে অবশ্য থামছে না কর্তৃত্ব কায়েমের লড়াই। ইয়েমেনকে নিমিত্ত করে আসলে যে সৌদি আরব ও ইরান আরব দুনিয়ায় প্রতিপত্তি বিস্তারের লড়াইয়ে নেমেছে, তা মোটামুটি স্পষ্ট। সে লক্ষ্যে পরের পদক্ষেপ কী হবে, তা এ দিন শুরু হওয়া আরব দুনিয়ার দেশগুলির শীর্ষ বৈঠকে স্থির হওয়ার কথা। তাতে ইয়েমেনের প্রেসিডেন্ট হাদি ছাড়াও ছিলেন সৌদি আরব, কুয়েত, বাহরাইন, জর্ডন, মিশরের মতো দেশের রাষ্ট্রনেতারা। সেখানেই সিদ্ধান্ত হয়, সমবেত ভাবে ইয়েমেনের শিয়া হুথি জঙ্গিদের থামানোর চেষ্টা করবে দেশগুলি।