চোখে জল এনে দিল চুয়াত্তরের চারণকবি

রয়্যাল অ্যালবার্ট হল-এ বসে গত বছরের সে দিনটা চোখ ভরে জল এসে গিয়েছিল। আমার সামনে, এই তো, মঞ্চে বব ডিলান! সাদা ফেদোরা আর কালো লং কোট পরে ৭৪ বছরের চারণকবি। ডিলানের মূর্ছনায় বদলে গিয়েছে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাগৃহ।

Advertisement

অঞ্জন দত্ত

শেষ আপডেট: ১৪ অক্টোবর ২০১৬ ০২:৪৩
Share:

রয়্যাল অ্যালবার্ট হল-এ বসে গত বছরের সে দিনটা চোখ ভরে জল এসে গিয়েছিল। আমার সামনে, এই তো, মঞ্চে বব ডিলান! সাদা ফেদোরা আর কালো লং কোট পরে ৭৪ বছরের চারণকবি। ডিলানের মূর্ছনায় বদলে গিয়েছে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাগৃহ। সেটা তখন ষাটের দশকের হলিউডি ছবির আদলে এক পানশালা, সেখানেই ডিলানের সুরেলা কণ্ঠ!

Advertisement

১৮ বছর বয়স থেকে গলাটা শুনে আসছি। সত্তর দশকে মেডিক্যাল কলেজ হস্টেলের সামনে ধোঁয়ায় সুখটান দিতে যেতাম। কানে ভেসে আসত গিটারের সঙ্গে গান: ‘আই হার্ড দ্য সং অব আ পোয়েট হু ডায়েড ইন দ্য গাটার।’ ...নর্দমায় যে মারা গেছে, সেই কবির গান আমি শুনেছি। শুনেছি ভাঁড়ের কান্না...

গানটা অ্যাসিড বৃষ্টি আর ভিয়েতনাম যুদ্ধ নিয়ে। কিন্তু দার্জিলিঙের হস্টেলে এক কিশোর ছেলেকে সেই গানই তার নিজের শহর কলকাতাকে ভাল ভাবে চিনতে শিখিয়েছিল, বুকের মধ্যে নিজের গান লেখার সাহস জুগিয়েছিল। সেই ছেলেটা সে দিন ৬২ বছর বয়সে প্রথম চোখের সামনে বব ডিলানকে দেখছে, তাঁর প্রোগ্রাম শুনছে। ‘বাট দেন কামস আ টাইম হোয়েন আই নিড ইউ,’ গাইছেন ডিলান।

Advertisement

প্রবাদপ্রতিম এই জিপসি কবিকে দেখতে সে দিন এক ঘণ্টা আগে হল-এ গৌঁছে গিয়েছি। রক অ্যান্ড রোল, ভেতরের অ্যাংগস্ট (এই শব্দটার বোধহয় বাংলা হয় না), ক্ষুরধার বিদ্রুপের সামাজিক বয়ান সব কিছু ঘটে যাবে আমার চোখের সামনে? ওই তো, মাইক হাতে এগিয়ে আসছেন তিনি। পাশে আমার পুত্র নীলও তত ক্ষণে উত্তেজিত। দুই প্রজন্মের ব্যবধানে দু’জনেই জানি, লাইভ পারফরম্যান্সে ডিলান নিয়ে এসেছেন নতুন যুগ। ৫০ বছর আগে এই হল-এই উচ্চকিত ইলেকট্রনিক ব্যাক আপ নিয়ে ‘টাইমস দে আর আ চেঞ্জিং’ গেয়েছিলেন, দর্শকদের তাঁকে ‘জুডাস’ বলে ডাকতে প্রলুব্ধ করেছিলেন! আজ মঞ্চে তিনি প্রৌঢ়। কিন্তু রসবোধ নষ্ট হয়নি এতটুকু। বব ডিলানই কি আমাদের আধুনিক সময়ের অতন্দ্র সাঙ্গীতিক প্রহরী?

সময়ের প্রহরী ছাড়া কীই বা বলা যেতে পারে? পিট সিগার একদা অভিনন্দন জানিয়েছিলেন প্রতিবাদে মুখর এই তরুণ গায়ককে। তার পর জোন বায়েজ তাঁর অ্যালবামে প্রেমের শ্রদ্ধার্ঘ্য দিলেন সহযোদ্ধাকে। বামপন্থীরা তখন, সেই ১৯৬৬ সালে তাঁকে বিশ্বাসঘাতক ভাবে। কিন্তু ডিলানকে দমাবে কে? জ্যাক নিকলসনের মতো অনেকেই তখন রক অ্যান্ড রোলে কোনও মেধা খুঁজে পান না। সত্যিই তাই? বব ডিলান সে সময় রক অ্যান্ড রোলে সরে না গেলে বিটলস কি গাইতে পারত ‘হাউস অব লর্ডস’? তার পরই এ সবের বাইরে গির্জার গসপেল সঙ্গীতের ধাঁচে এল অন্য নিরীক্ষা: ‘হোয়েন দ্য ডিল গোজ ডাউন’ বা ‘বিয়ন্ড দ্য হরাইজন’। এই বিপন্ন রোমান্টিক তো বারংবারই প্রমাণ করেছেন, প্রতিভা কখনও এক জায়গায় থেমে থাকে না।

ইউ টিউবে এর আগে ডিলানের গলায় ফ্রাঙ্ক সিনাত্রার ‘শ্যাডোজ ইন দ্য নাইট’ শুনে ভেঙে চৌচির হয়ে গিয়েছিলাম। কেন ডিলান গাইতে গেলেন এই গান? ৭৪ বছরের কণ্ঠে পুরনো দিনের সেই সব গান মনের মধ্যে এক ব্যথা জাগিয়ে তুলছিল, চোখের জল আর আটকাতে পারিনি।

বব ডিলান দাঁড়িয়ে গাইছিলেন, মাঝে মাঝে পিয়ানোর কি বোর্ডে খেলা করছিলেন। তথাকথিত সুপারহিটগুলো গাননি। কিন্তু তাঁর গলায় পুরনো দিনের ‘পে ইন ব্লাড’ বা ‘স্কারলেট টাউন’ প্রতি মুহূর্তে মনে পড়িয়ে দিচ্ছিল, রক অ্যান্ড রোল কত মসৃণ ভাবে সীমানা ভেঙে জ্যাজকে ছুঁয়ে যেতে পারে। ডিলান গাইলেন ‘হোয়েন আই অ্যাম অ্যালোন উইথ ড্রিম্স অব ইউ, দ্যাট ওন্ট কাম ট্রু… সেই দানাদার নিস্পৃহ গলা! ফ্রাঙ্ক সিনাত্রার গানেই যেন এই ভোগবাদী সমাজের নিরাসক্ত শূন্যতাকে মনে পড়িয়ে দিলেন ডিলান।

দু’ঘণ্টার জাদু শেষ হল। টানা চার মিনিট স্ট্যান্ডিং ওভেশন। ডিলান ফিরে এসে এ বার পিয়ানোতে বসলেন। ‘ব্লোয়িং ইন দ্য উইন্ড’-এর নমনীয় দ্যুতির সুরেলা মূর্ছনায় আক্রান্ত সারা হল। বেরোনোর
পর গিটারিস্ট অমিত দত্ত আমায় জিজ্ঞাসা করেছিল, কেমন দেখলে? সার্থক হল স্বপ্ন?

আমি ফের কেঁদে ফেলেছিলাম।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন