India Bangladesh Diplomacy

সংখ্যালঘু প্রশ্নে দিল্লির বক্তব্য ‘উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’, দাবি ঢাকার! হাদির হত্যাকারীদের ‘ভারতে অনুপ্রবেশ’ নিয়েও চাপানউতর

বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকারের জমানায় কত বার সংখ্যালঘুদের উপরে নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে, গত শুক্রবার সেই পরিসংখ্যান তুলে ধরেছিল ভারতীয় বিদেশ মন্ত্রক। উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল সংখ্যালঘুদের পরিস্থিতি নিয়ে। দিল্লির বিবৃতির ৪৮ ঘণ্টা পরে এ বার পাল্টা বিবৃতি দিল ঢাকা।

Advertisement

আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক

শেষ আপডেট: ২৮ ডিসেম্বর ২০২৫ ২২:৩২
Share:

(বাঁ দিকে) ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস (ডান দিকে)। — ফাইল চিত্র।

বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের উপরে নির্যাতনের যে অভিযোগ উঠেছে, তা মানতেই চাইছে না সে দেশের অন্তর্বর্তী সরকার। উল্টে এ বিষয়ে ভারতের উদ্বেগকেই বিভ্রান্তিকর, অতিরঞ্জিত এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে দাবি করছে তারা। শুধু তা-ই নয়, বাংলাদেশের তরুণ নেতা ওসমান হাদির হত্যাকারীরা কোথায় রয়েছে, তা নিয়েও দু’দেশের মধ্যে চলল বিবৃতি এবং পাল্টা বিবৃতি।

Advertisement

গত সপ্তাহে হাদির মৃত্যুর পর থেকে নতুন করে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে বাংলাদেশ। ওই উত্তেজনার পরিস্থিতির মাঝেই ময়মনসিংহে দীপুচন্দ্র দাস নামে এক যুবককে পিটিয়ে খুন করা হয়। দেহে আগুনও ধরিয়ে দেওয়া হয় বলে অভিযোগ। ময়মনসিংহে যুবক খুনের ঘটনার পর থেকে সম্প্রতি দ্বিতীয় বার পড়শি দেশে সংখ্যালঘুদের পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ভারত। দু’বারই দিল্লির বক্তব্যে আপত্তি জানিয়ে পাল্টা বিবৃতি দিয়েছে মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার।

বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকারের জমানায় কত বার সংখ্যালঘুদের উপরে নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে, গত শুক্রবার সেই পরিসংখ্যান তুলে ধরেছিল ভারতীয় বিদেশ মন্ত্রক। উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল সংখ্যালঘুদের পরিস্থিতি নিয়ে। দিল্লির বিবৃতির ৪৮ ঘণ্টা পরে এ বার পাল্টা বিবৃতি দিল ঢাকা। ইউনূস সরকারের বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র এস এম মাহবুবুল আলম বলেন, “বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের পরিস্থিতি সম্পর্কে ভারতের বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্রের সাম্প্রতিক মন্তব্য আমাদের নজরে এসেছে। তাঁর মন্তব্য বাস্তব পরিস্থিতির প্রতিফলন নয়। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দীর্ঘদিনের ঐতিহ্যকে ভুল ভাবে উপস্থাপন করে, এমন বিভ্রান্তিকর, অতিরঞ্জিত বা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বর্ণনাকে বাংলাদেশ সরকার স্পষ্ট ভাবে প্রত্যাখ্যান করে।” ইউনূস সরকারের দাবি, বিচ্ছিন্ন কিছু অপরাধমূলক ঘটনাকে পরিকল্পিত ভাবে সংখ্যালঘুদের উপর প্রাতিষ্ঠানিক নিপীড়ন হিসাবে দেখানোর চেষ্টা হচ্ছে।

Advertisement

বস্তুত, গত শুক্রবার দিল্লিতে বিদেশ মন্ত্রকের সাপ্তাহিক সাংবাদিক বৈঠকের একটি বড় অংশ জুড়ে ছিল বাংলাদেশের পরিস্থিতি। বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল জানিয়েছিলেন, পড়শি দেশে চরমপন্থীরা যে ভাবে হিন্দু, খ্রিস্টান ও বৌদ্ধ-সহ সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে যে আচরণ করছেন, তা অত্যন্ত উদ্বেগের। ময়মনসিংহে যুবক খুনের ঘটনাতেও ফের এক বার নিন্দা জানিয়েছিল ভারত। নয়াদিল্লি এ-ও জানিয়েছিল, বিভিন্ন বেসরকারি সূত্রে জানা গিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে সংখ্যালঘুদের উপর ২৯০০-র বেশি হিংসার ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে হত্যা, অগ্নিসংযোগ এবং জমিদখলের অভিযোগও রয়েছে। এই ধরনের ঘটনাগুলিকে শুধুই রাজনৈতিক অশান্তি বলে উড়়িয়ে দেওয়া যায় না, তা-ও স্পষ্ট করে দিয়েছিল ভারতীয় বিদেশ মন্ত্রক। তবে দিল্লির এই বক্তব্যকে মানতে চায় না ঢাকা।

শেখ হাসিনাকে কেন্দ্র করে ভারত এবং বাংলাদেশের মধ্যে আগে থেকেই কূটনৈতিক টানাপড়েন চলছে। ময়মনসিংহের ঘটনার পরে সেই টানাপড়েন আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। তার সঙ্গে জুড়েছে হাদি হত্যার তদন্ত ঘিরে ইউনূস সরকারের ঘরোয়া অস্বস্তিও। হাদির হত্যাকারীরা বাংলাদেশেই রয়েছে, নাকি বিদেশে পালিয়েছে— সে বিষয়ে কয়েক দিন আগে পর্যন্তও কোনও সুনির্দিষ্ট তথ্য ছিল না বাংলাদেশের পুলিশের কাছে। রবিবার দুপুরে আচমকাই তারা বিবৃতি দিয়ে জানায়, হাদির হত্যাকারী দুই মূল অভিযুক্ত ভারতে পালিয়ে গিয়েছে। মেঘালয় হয়ে তাঁরা ভারতে প্রবেশ করেছেন বলে দাবি করে ঢাকা পুলিশ। যদিও ওই দাবির গ্রহণযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন উঠে গেল মেঘালয় পুলিশ এবং বিএসএফ-এর পাল্টা বক্তব্যে।

হাদি হত্যাকারীদের নিয়ে ঢাকার বিবৃতি

হাদিকে খুনের ঘটনায় অভিযুক্ত ফয়সাল করিম এবং আলমগীর শেখ মেঘালয় হয়ে ভারতে পালিয়ে গিয়েছে বলে দাবি করে ঢাকা পুলিশ। রবিবার দুপুরে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) এনএন মহম্মদ নজরুল ইসলাম দাবি করেন, ওই দুই অভিযুক্তকে সাহায্যকারী দুই ভারতীয়কে গ্রেফতার করেছে মেঘালয়ের পুলিশ। তিনি বলেন, ‘‘হাদির হত্যাকাণ্ড পূর্বপরিকল্পিত। ঘটনার পর ফয়সাল ও আলমগীর ঢাকা থেকে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় আমিনবাজারে যান। সেখান থেকে গাড়িতে করে কালামপুরে যান। কালামপুর থেকে আর একটি গাড়িতে করে ময়মনসিংহ সীমান্তে যান। সেখানে ফয়সাল ও আলমগীরকে নেন ফিলিপ পাল ও সঞ্জয়। তাঁরা সীমান্তে অবৈধ ভাবে মানুষ পারাপার করেন। পরে ফিলিপ দু’জনকে ভারতের মেঘালয় রাজ্যে নিয়ে যান।’’ ঢাকা মহানগরের পুলিশ অতিরিক্ত কমিশনার জানিয়েছেন, ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট সীমান্ত দিয়ে মেঘালয়ে পালান ফয়সাল এবং আলমগীর শেখ।

নজরুল ইসলামের বক্তব্যকে উদ্ধৃত করে ডেইলি স্টার বলেছে, ‘‘আমাদের কাছে যা খবর, তা থেকে জানা গিয়েছে যে, হালুয়াঘাট সীমান্ত দিয়ে সন্দেহভাজনেরা মেঘালয়ে পালিয়েছেন। সীমান্ত পেরোনোর পর প্রাথমিক ভাবে ওই সন্দেহভাজনেরা পূর্তি নামে এক ব্যক্তির সঙ্গে দেখা করেন। তার পর সামি নামে এক ট্যাক্সিচালক সন্দেহভাজনদের তুরা শহরে পৌঁছে দেন।’’ তার কিছু পরেই ঢাকা মহানগরের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার জানান, ফয়সালের দুই সহযোগী পূর্তি এবং সামিকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

ঢাকার দাবি ওড়াল মেঘালয় পুলিশ এবং বিএসএফ

হাদির হত্যাকারীদের সহযোগীরা ভারতে গ্রেফতার হয়েছেন বলে দাবি যে দাবি করেছে ঢাকা পুলিশ, তা উড়িয়ে দিয়েছে মেঘালয় পুলিশ এবং বিএসএফ। শুধু তা-ই নয়, অভিযুক্ত ফয়সাল সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে ঢুকেছে, তার কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছে মেঘালয় পুলিশ। বাংলাদেশি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরকে ‘অসত্য’ বলে দাবি করেছে মেঘালয় পুলিশ। সেখানকার পুলিশের এক ঊর্ধ্বতন কর্তা ‘হিন্দুস্তান টাইমস’-কে বলেন, ‘‘বাংলাদেশ পুলিশের থেকে আনুষ্ঠানিক ভাবে যোগাযোগ করা হয়নি। প্রতিবেদনে উল্লিখিত কোনও অভিযুক্তকে গারো পাহাড়ে খুঁজে পাওয়া যায়নি। কোনও গ্রেফতারও হয়নি।’’

মেঘালয় পুলিশকে সমর্থন করে বিবৃতি দিয়েছে বিএসএফের (মেঘালয় ফ্রন্টিয়ার) প্রধান ওপি উপাধ্যায়। তিনি বলেন, ‘‘হালুয়াঘাট সীমান্ত দিয়ে সন্দেহভাজনদের মেঘালয়ে প্রবেশের কোনও প্রমাণ নেই। বিএসএফ এ ধরনের কোনও ঘটনা সম্পর্কে অবগত নয়। এই দাবিগুলি ভিত্তিহীন এবং বিভ্রান্তিকর।’’

হাদি হত্যার তদন্ত নিয়ে চাপে ইউনূসেরা

হাদি হত্যার তদন্ত নিয়ে অস্বস্তিতে রয়েছে ইউনূসের সরকার। প্রশ্নের মুখে পড়েছে বাংলাদেশের পুলিশ এবং তদন্তকারী সংস্থার ভূমিকাও। ইউনূসদের উপর ধারাবাহিক চাপ তৈরি করেছে হাদির সংগঠন ইনকিলাব মঞ্চ। এ অবস্থায় রবিবার ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার দাবি করেছে, তাদের জমানাতেই হাদি হত্যার বিচার শেষ হবে। অন্তর্বর্তী সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, “বর্তমান এই অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদেই হাদি ভাইয়ের হত্যার বিচার সম্পন্ন হবে।” আগামী ১২ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশে নির্বাচন রয়েছে। তার পরে বাংলাদেশের শাসনভার চলে যাবে নির্বাচিত কোনও সরকারের হাতে। জাহাঙ্গীরের দাবি, নতুন সরকার বাংলাদেশে ক্ষমতায় আসার আগেই অন্তর্বর্তী সরকার হাদি হত্যার বিচার প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ করে ফেলবে। এ দিকে ঢাকায় শাহবাগ চত্বরে ন্যায়বিচারের দাবিতে টানা অবস্থান চালিয়ে যাচ্ছে ইনকিলাব মঞ্চ।

জামাত -এনসিপি জোট

বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচনে জামায়েতে ইসলামি (যা জামাত নামেই পরিচিত)-র সঙ্গে জোট বেঁধে ফেলল হাসিনা বিরোধী আন্দোলন থেকে উঠে আসা নতুন রাজনৈতিক দল এনসিপির। রবিবার আনুষ্ঠানিক ভাবে এই নির্বাচনী সমঝোতার কথা ঘোষণা করেছে দুই দলই। তবে জামাতের সঙ্গে জোটে সায় নেই এনসিপি-র একাংশেরই। তা নিয়ে সংগঠনের অন্দরে বিরোধও দানা বাঁধতে শুরু করেছে। দল থেকে ইতিমধ্যে সরে দাঁড়িয়েছেন এনসিপির দুই শীর্ষস্থানীয় নেত্রী তাসনিম জারা এবং তাসনূভা জাবীন। জোটে নীতিগত আপত্তি জানিয়ে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামকে স্মারকলিপি জমা দিয়েছেন দলের ৩০ জন বিক্ষুব্ধ নেতাও। তবে দলের অন্দরে এই অসন্তোষের মধ্যেই জামাতের সঙ্গে জোট ঘোষণা করে দিল এনসিপি।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement