নিহত ৮৬

রক্তাক্ত শান্তি-সমাবেশ: সন্ত্রাস নাকি ষড়যন্ত্র, প্রশ্ন তুরস্কবাসীর

সকাল তখন সবে দশটা। শহরের ব্যস্ততা তুঙ্গে। আঙ্কারা-র সেন্ট্রাল স্টেশনের কাছে সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখাচ্ছিলেন এক দল লোক। তাঁদের দাবি, ‘কুর্দদের বিরুদ্ধে আর যুদ্ধ নয়, শান্তি চাই’। বড়দের সঙ্গে প্রতিবাদ মিছিলে পা মেলান অল্পবয়সিরাও। হাতে হাত রেখে গানের সুরে বিক্ষোভ দেখাচ্ছিলেন তাঁরা।

Advertisement

সংবাদ সংস্থা

আঙ্কারা শেষ আপডেট: ১১ অক্টোবর ২০১৫ ০০:০০
Share:

চারপাশে মৃতদেহ। তারই মধ্যে জখম দুই বিক্ষোভকারী। শনিবার আঙ্কারার সেন্ট্রাল স্টেশনের বাইরে। ছবি: এএফপি।

সকাল তখন সবে দশটা। শহরের ব্যস্ততা তুঙ্গে। আঙ্কারা-র সেন্ট্রাল স্টেশনের কাছে সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখাচ্ছিলেন এক দল লোক। তাঁদের দাবি, ‘কুর্দদের বিরুদ্ধে আর যুদ্ধ নয়, শান্তি চাই’। বড়দের সঙ্গে প্রতিবাদ মিছিলে পা মেলান অল্পবয়সিরাও। হাতে হাত রেখে গানের সুরে বিক্ষোভ দেখাচ্ছিলেন তাঁরা।

Advertisement

তাল কাটল হঠাৎই। মুহূর্তের ব্যবধানে দু’-দু’বার বিস্ফোরণে কেঁপে উঠল রাজধানী। নিমেষে বদলে গেল ছবিটা। মাটিতে ছিটকে পড়ল হাতের পতাকাগুলো। লুটিয়ে পড়লেন বিক্ষোভকারীদের অনেকেই। চারপাশে ছিন্নভিন্ন দেহ। রক্তে লাল

হয়ে উঠল রাজপথ।

Advertisement

‘সন্ত্রাস-আক্রান্ত আঙ্কারা’, ঘোষণা করেছে তুর্কি প্রশাসন। তাদের দাবি, দু’জন আত্মঘাতী জঙ্গি ছিল সমাবেশেই। যদিও এখনও পর্যন্ত কোনও জঙ্গি সংগঠন হামলার দায় স্বীকার করেনি। নিহতের সংখ্যা ৮৬। জখম প্রায় দু’শো।

একের পর এক বিক্ষিপ্ত সন্ত্রাস হামলার ঘটনায় জুলাইয়ের পর থেকেই সতর্কতা জারি রয়েছে ন্যাটোর সদস্য দেশ তুরস্কে। এমনিতেই ইসলামিক স্টেটের (আইএস) কুনজরে রয়েছে তারা। আইএসকে ধ্বংস করতে ন্যাটোর হয়ে সিরিয়া ও ইরাকে লড়ছে তুর্কি সেনা। সংঘর্ষ জারি রয়েছে কুর্দ জঙ্গিদের বিরুদ্ধেও। টানা যুদ্ধে বিধ্বস্ত তুরস্কবাসীর একটা বড় অংশের দাবি ছিল, সংঘর্ষ এ বার থামুক। সেই দাবি জানাতেই বেশ কিছু বামপন্থী সংগঠন ও কুর্দ সমর্থক গোষ্ঠী আজ জড়ো হয় সেন্ট্রাল স্টেশনের বাইরে। কিন্তু শান্তি-সমাবেশই যে এ ভাবে রক্তাক্ত হতে চলেছে, তার আঁচ পাননি কেউই।

হাতে হাত ধরে গোল হয়ে বিক্ষোভ দেখাচ্ছিলেন এক দল অল্পবয়সি ছেলেমেয়ে। সকলেই কমবেশি স্কুল-কলেজের পড়ুয়া। সুর করে বিক্ষোভ দেখাচ্ছিলেন তাঁরা, ‘দিজ স্কোয়্যার, ব্লাডি স্কোয়ার...।’ তাঁদের সেই ছবি ভিডিও করেছিলেন ভিড়েরই কেউ। পরে তা ছড়িয়ে পড়ে সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে। ভিডিওতে দেখা যায়, ওই যুবক-যুবতীদের পিছনেই সমাবেশের ভিড়ে হঠাৎই জ্বলে উঠল আগুন। বিকট আওয়াজে কেঁপে উঠল চারপাশ। ছত্রভঙ্গ জনতা ছুটতে শুরু করল উদ্দেশ্যহীন ভাবে।

সমাবেশের কাছেই দাঁড়িয়েছিলেন ওয়া বারলাস। তাঁর কথায়, ‘‘প্রথম বিস্ফোরণটা হতেই চমকে যাই। কোনও কিছু না ভেবে পাগলের মতো ছুটতে থাকি।’’ কিছু ক্ষণ বাদে হুঁশ ফেরে। আহতদের সাহায্য করতে ফিরে যান বিস্ফোরণস্থলে। ‘‘তখন ওখানে শুধুই ছিন্নভিন্ন দেহ। চাপ চাপ রক্ত,’’ ডুকরে কেঁদে উঠলেন ওয়া।

স্টেশনে ছিলেন কাগজ-বিক্রেতা সেরদার। বললেন, ‘‘ভয়ে কাগজের বান্ডিলের আড়ালে লুকিয়ে পড়ি। কানে আসে কাচ ভাঙার আওয়াজ। পর ক্ষণেই ফের বীভৎস শব্দ। চারপাশে কান্না, হাহাকার। নাকে এল পোড়া মাংসের গন্ধও।’’ বিস্ফোরকের মধ্যে ভাঙা কাচের টুকরো, স্‌প্লিন্টার, পেরেক ছিল। অনেককেই দেখা গেল প্রাণে বাঁচলেও পেরেক-স্‌প্লিন্টারের আঘাতে গুরুতর জখম। ‘‘একটা শান্তি সমাবেশে এমন হামলা... মানে খুঁজে পাচ্ছি না।’’ কাঁদতে কাঁদতে বললেন আহমেত ওনেন।

ওয়ার মতো অনেকেই ফিরে এসেছিলেন ঘটনাস্থলে। পুলিশ-অ্যাম্বুল্যান্স আসার আগেই উদ্ধার-কাজে হাত লাগান তাঁরা। বিক্ষোভকারীদের পতাকাগুলোকে স্ট্রেচারের মতো করে আহতদের তুলে নেন তাতে। তার পর নিজেরাই গাড়ি নিয়ে ছোটেন হাসপাতালে। ইতিমধ্যে পুলিশ এসে ঘিরে ফেলে বিস্ফোরণস্থল। বিক্ষোভকারীরা তখন স্লোগান দিতে শুরু করেন, ‘‘পুলিশই খুনি...।’’ পরে তাঁরা মিছিলও বের করেন। মন্ত্রীরা এলে বোতল ছুড়ে মারে বিক্ষুব্ধ জনতা।

হামলার এ দৃশ্য তুরস্কে একেবারে অপরিচিত নয়। গত জুলাই মাসে দক্ষিণ-পূর্ব তুরস্কের এমনই এক হামলায় ৩২ জন কুর্দ-সমর্থক খুন হন। সে বারও কোনও জঙ্গি সংগঠন দায় নেয়নি। তুরস্ক প্রশাসন সে বারও আইএস-এর দিকে আঙুল তুলেছিল। সেই থেকে অস্থিরতা রয়েছে দেশের দক্ষিণ-পূর্বে। তুর্কি প্রশাসন ও কুর্দ বিদ্রোহীদের সংঘর্ষে প্রায়ই কেউ না কেউ মরছে সেখানে। তবে সম্প্রতি এত বড় মাপের হামলা আগে দেখেনি আঙ্কারা।

বিক্ষুব্ধদের অনেকেরই দাবি, ‘‘রাজনৈতিক ফায়দা তুলতে আর কুর্দদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ জারি রাখতে সবটাই আসলে খুনি প্রেসিডেন্ট তাইয়েপ এর্দোগানের ষড়যন্ত্র।’’ সেদাত কারতাল নামে এক বাসিন্দা যেমন বললেন, ‘‘খুব শিগগিরি এমন কিছু যে ঘটবে, আগেই ভয় পেয়েছিলাম। তবে এ ভাবে শান্তি মিছিলে...! ভাবিনি।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন