আমার ছেলের বিয়েতে কলকাতায় এলেন

জয় গুরু! জয় গুরু! জয় নিতাই!! কিছুক্ষণ আগেই খবরটা শুনলাম। মনটা ভরে গেল গো! সে অনেক বছর আগের কথা। স্মৃতিও খানিকটা দুর্বল হয়ে গিয়েছে। তাই সব কথা মনে নেই।

Advertisement

পূর্ণচন্দ্র দাস বাউল

শেষ আপডেট: ১৪ অক্টোবর ২০১৬ ০২:৫০
Share:

ববের পাশে। ছবি পারিবারিক সৌজন্যে পাওয়া।

জয় গুরু! জয় গুরু! জয় নিতাই!! কিছুক্ষণ আগেই খবরটা শুনলাম। মনটা ভরে গেল গো!

Advertisement

সে অনেক বছর আগের কথা। স্মৃতিও খানিকটা দুর্বল হয়ে গিয়েছে। তাই সব কথা মনে নেই। তবু আজ সন্ধেয় ওঁর নোবেল পাওয়ার খবরটা পেয়ে একটা ছবি ভেসে উঠল। এক সাহেব বাউল। ছেঁড়া জিনস, তাপ্পি মারা কোট, হাতে গিটার, সব সময় গান গাইছে। আমেরিকার মতো বিরাট এক দেশের এক বাউল।

দেখা হল যখন, তখন তাঁর একটাই দাবি। একসঙ্গে থাকবে। গান গাইবে। ভারতের বাউলদের জীবন-যাপন শিখবে। আমাদের বাদ্যযন্ত্রগুলিকে আত্মস্থ করবে। বাউল গানের কথা, গানের চলন, তাল, ছন্দ। কেটেওছে ওই সময় দুই পাগলে। কত গান গেয়েছি, আর কত গান নিয়ে যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে — ঠিক নেই।

Advertisement

সময়টা ষাটের দশকের শেষ দিক। ওই সময়েই আমি আমেরিকা গিয়েছিলাম। আমার বয়স তখন ৩০-৩২। গানও গাইছি সে রকম। কালীঘাটের কাছে কালী টেম্পল রোডে একটি যাত্রী নিবাসে ওই সময় থাকতাম। আমার গান শুনে যোগাযোগ করার জন্য ওই সময় অতুল্য ঘোষ আর প্রফুল্ল সেন মিলে একটি টেলিফোনের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। হঠাৎ এক দিন ওই টেলিফোনে গ্র্যান্ড হোটেল থেকে ফোন। কী ব্যাপার? না, এক সাহেব আমার সঙ্গে দেখা করতে চাইছেন। কোথায় তিনি আমার সঙ্গে দেখা করতে যাবেন, তা জানতে চাইলেন হোটেল ম্যানেজার। যাত্রী নিবাসের ওই ছোট ঘরে সাহেবকে আসতে বলি কী করে! হোটেলের ম্যানেজারকে বললাম, আমিই হোটেলে যাব। ম্যানেজার বললেন, সাহেব বলেছেন সঙ্গে যন্ত্রটা নিয়ে যেতে। মেনে নিলাম। বাউলের যা-যা যন্ত্র হয়, সে সব নিয়ে আমি আর আমার স্ত্রী মঞ্জু গ্র্যান্ড হোটেলে পৌঁছলাম। কথা বলে সাহেবের নাম জানলাম, অ্যালবার্ট গ্রসম্যান। গান শোনার পর তিনি বললেন, ‘‘আমেরিকায় যেতে পারবেন? ওখানে গান গাইতে হবে।’’ এও জানালেন, বব ডিলান আমার সঙ্গে দেখা করতে চান। বললেন, ‘‘ডিলানও তোমার মতো এক বাউল।’’ আমেরিকায় গেলে তাঁর সঙ্গে দেখা হবে। বিভিন্ন উৎসবে গান গাইতে হবে। রাজি হয়ে গেলাম। অ্যালবার্ট জানালেন, আমেরিকায় এক বছর থাকতে হবে। সেই মতো যেন প্রস্তুতি নিই। সময় মতো ডেকে নেবেন।

সে ডাক কিন্তু এসেছিল। ১০ জনের একটি দল নিয়ে আমেরিকায় গিয়েছিলাম আমরা। এই অ্যালবার্ট সাহেবই আমাকে বব ডিলানের জন্মশহর বিয়ার্সভিলে নিয়ে গিয়েছিলেন। পরে জেনেছিলাম, এই অ্যালবার্ট সাহেব তখনকার মার্কিন লোকশিল্পীদের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক। দীর্ঘদিন ববের ম্যানেজারও ছিলেন। এটুকু মনে আছে, প্রথম দেখায় ববকে বাউল ছাড়া সত্যিই অন্য কিছু মনে হয়নি। ইংরেজি ভাষা তখন বিশেষ বুঝতাম না। কিন্তু আমিও বাউল তো! মনের কথা, ভাবগুলো ঠিক ধরে ফেলতাম। বুঝতে পারতাম, তিনি কী বলতে চাইছেন। কোথায় তাঁর মনের ব্যথা। কোথায় তাঁর লড়াই। গানটাও সেই রকমই গাইতেন। যতটুকু মনে পড়ছে, আমেরিকায় বিভিন্ন শহরে ঘুরে প্রায় ৪০-৪২টা অনুষ্ঠান করেছিলাম। কোথাও বব ডিলানও তাঁর দল নিয়ে গিয়েছেন, আমিও আমার দল নিয়ে গেয়েছি। কোথাও বব নিজে আমাদের সঙ্গে গিটার নিয়ে হাত মিলিয়েছেন, গলা মিলিয়েছেন। সে যে কী দিন! কত মানবতার গান, কত মানব প্রেমের গান গেয়েছি, আজ ভাবলে চোখ ফেটে জল আসে। কিছু গান একসঙ্গে রেকর্ডও করেছিলাম। একটা বেশ মজার ঘটনা মনে আছে। বিয়ার্সভিলে যাওয়ার পর বব ডিলান যখন জানতে পারলেন, আমরা খালি ভাত খাই, তখন এক বস্তা চাল পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। আর বলেছিলেন, যত দিন না ওই চাল শেষ হয়, তত দিন কোথাও যাওয়া যাবে না। আমরা একটা কাঠের বাড়িতে থাকতাম। ডিলান নিজে মাঝে মাঝেই এসে মঞ্জুর রান্না খিচুড়ি খেয়ে যেতেন।

তার পর অনেক দিন আর আমার সঙ্গে যোগাযোগ ছিল না। কিন্তু খবর পাঠানো মাত্র আমার ছোট ছেলের বিয়েতে এসে ঘুরে গিয়েছিলেন। সেটা ১৯৯০ সালের জানুয়ারি। বালিগঞ্জ ফাঁড়ির সেই বিয়েবাড়িতে ওঁর আসার খবর কোথাও বলা সে দিন বারণ ছিল। যে কারণে ছবিও তোলা হয়নি। এত দিন পরে এখন আর বলতে বাধা নেই। গোপনে সে বার কলকাতায় এসেছিলেন ডিলান। এক রাত থাকার কথা ছিল। কিন্তু কোনও ভাবে আঁচ করেছিলেন কেউ কেউ। মুম্বই থেকে বেশ কিছু ফোন আসতে লাগল। ডিলান আর ঝুঁকি না নিয়ে সে রাতেই ফের রওনা দিলেন।

খুব আনন্দ হচ্ছে আজ। ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিচ্ছে, আর এক বাউলই নোবেল পেলেন। আমাদের আর এক কবি, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, যিনি নিজেও মননে বাউল ছিলেন, নোবেল পেয়েছিলেন। বাউল হয়ে এ জীবনে আমার আর কী পাওয়ার থাকতে পারে! সবই তো পাওয়া হয়ে গেল! দেখি, একবার ববের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করব। জানি না পারব কি না!
এখন তো শব্দে নয়, স্মৃতির পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে মনে মনেই কথা হয় ওঁর সঙ্গে।

অনুলিখন: পিনাকী বন্দ্যোপাধ্যায়

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন