কোথায় গর্ত ‘ফ্লাওয়ার্সে’, দেখাচ্ছেন প্রদর্শশালার কর্তা। মঙ্গলবার। ছবি আয়োজক সংস্থার সৌজন্যে।
বেসামাল থাবায় ফর্দাফাঁই ১০ কোটি টাকার ‘অমূল্য’ ইতালীয় স্টিল লাইফ। নেহাতই এক দুর্ঘটনা। কিন্তু তাতেই কপাল পুড়ল লিওনার্দো দা ভিঞ্চির উত্তরসূরি ইতালির চিত্রশিল্পী পাওলো পোরপোরা-র। আর রাতারাতি সারা বিশ্বের শিল্প-অনুরাগীদের চোখে ‘খলনায়ক’ বছর বারোর এক বালক। একযোগে অভিযোগ, তার ছোট্ট হাতের চাপেই আজ প্রমাণ আকারের গর্ত তেল রঙের ক্যানভাসে। রীতিমতো বরবাদ রেনেসাঁস-পরবর্তী শিল্পী পাওলোর একমাত্র স্বাক্ষরিত তৈলচিত্রটি।
তাইওয়ানের রাজধানী তাইপেইয়ের একটি প্রদর্শশালায় রবিবারের ঘটনা। আয়োজক সংস্থাটির দাবি, ‘ফেস অব লিওনার্দো: ইমেজেস অব জিনিয়াস’ নামের ওই প্রদর্শনীতে ৫০টি ছবির মধ্যে দা ভিঞ্চির আঁকা একটি আত্মপ্রতিকৃতিও ছিল। যার মূল্য ‘ফ্লাওয়ার্স’-এর থেকে অন্তত ২০০ গুণ বেশি। দুর্ঘটনার পর সেটি যে এখনও অক্ষত রয়েছে, আপাতত তাতেই স্বস্তি প্রদর্শনী-কর্তাদের।
বিশেষজ্ঞদের তত্ত্বাবধানে ইতিমধ্যেই ‘ফ্লাওয়ার্স’ নামের ওই ছবিটির পুনরুদ্ধারের কাজ শুরু হয়েছে। খরচ জোগানোর ভার সংশ্লিষ্ট বিমা সংস্থার। ছেলেটির মুখ অবশ্য এখনও কাঁচুমাচু। অপরাধ বোধও বেশ স্পষ্ট। যদিও ক্ষতিপূরণ আদায়ে তার পরিবারের উপর কোনও চাপ দেওয়া হবে না বলে জানিয়েছেন প্রদর্শনীর আয়োজক কর্তারা।
ঠিক কী ঘটেছিল সে দিন? আজই প্রদর্শশালার সিসিটিভি ফুটেজ প্রকাশ করেছে আয়োজক সংস্থাটি। তাতে স্পষ্ট, প্রদর্শনী চলাকালীন হঠাৎই ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে ছেলেটি। দেওয়াল ধরে টাল সামলাতে চায় সে। কিন্তু সেই দেওয়াল যে আসলে ‘গ্রেট ওয়াল’, যাতে ঝোলানো পাওলোর প্রায় সাড়ে তিনশো বছরের পুরনো তৈলচিত্র — আগেভাগে ঠাহর হয়নি তার। বিপর্যয় তাই পলক ফেলার আগেই।
কিন্তু এই বিপর্যয় এড়ানো গেল না কেন? প্রশ্ন উঠছে। প্রশ্ন উঠছে, প্রদর্শনীর সতর্কতামূলক বন্দোবস্ত নিয়েও। যার উত্তরে আজ আয়োজক সংস্থার তরফে সুন চি সুয়ান বলেন, ‘‘প্রত্যেকটি ছবির অন্তত ৮০ সেন্টিমিটার আগে দড়ি ইত্যাদি দিয়ে ব্যারিকেড করা ছিল। ছেলেটির হাতে ঠান্ডা পানীয়ের গ্লাস ছিল সে সময়। সেই কারণেই হয়তো টাল সামলাতে পারেনি এবং দড়ির উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে সে।’’ ঘটনাস্থলে সে সময় প্রায় ৩০০ জন দর্শক ছিলেন বলে জানান তিনি। যা কি না, সাধারণের চেয়ে খানিকটা বেশিই। পরিস্থিতির সামাল দিতে আজ সকালে অল্প সময়ের জন্য বন্ধ রাখা হয় প্রদর্শনী। পাওলোর ছবি বাদ রেখেই পরে ফের তা চালু হয়।
যা নিয়ে কিছুটা উত্তেজনাও ছড়ায় আজ। কারণ, ভিঞ্চির দেশে পাওলোকে নিয়ে পাগলামি এখনও নেহাত কম নয়। পাওলোর জন্ম ১৬১৭ সালে। ছাপ্পান্ন বছর ধরে ক্যানভাসের উপর তেল রঙে নিরলস কাজ করে গিয়েছেন। বেশির ভাগই স্টিল লাইফ এবং আদ্যোপান্ত গতিময়। তাঁর বেশির ভাগ ছবিই মূলত রোম থেকে পাওয়া গিয়েছে। অবশ্য প্রদর্শনীর ক্ষতিগ্রস্ত ছবিটি পাওলোরই কি না, তা নিয়ে ধন্দ তৈরি হয় ইতালীয় সংবাদমাধ্যমের একাংশের রিপোর্টে। ছবিটিকে পাওলোর সমসাময়িক ইতালীয় শিল্পী মারিও নুজ্জি-র ছবি বলেও দাবি করেন অনেকে। প্রদর্শনীর আয়োজক সংস্থা অবশ্য তা উড়িয়ে দিয়ে আজ জানান, তৈলচিত্রটি পাওলোরই আঁকা। এবং এখনও পর্যন্ত পাওয়া এটিই তাঁর একমাত্র তারিখ দেওয়া স্বাক্ষরিত ছবি।
অথচ রবিবারের দুর্ঘটনার পর এখন সেটিই প্রায় বাতিলের পর্যায়ে। পুনরুদ্ধার শেষ হলেও, ‘খুঁতো’ ছবির গুরুত্ব যে কমবে, আশঙ্কা খোদ সুনেরই। আন্তর্জাতিক শিল্প বিশেষজ্ঞদের একটা অংশ অবশ্য এখনও আশাবাদী। প্রদর্শশালা কিংবা জাদুঘরে এমন দুর্ঘটনা যে প্রথম নয়, তা-ও মনে করিয়ে দিচ্ছেন তাঁরা। ২০০৬-এ জুতোর ফিতে জড়িয়ে খানিকটা এ ভাবেই কেমব্রিজের একটি প্রদর্শশালায় তিনটি বহুমূল্য চিনা ফুলদানি ভেঙে ফেলেন এক অত্যুৎসাহী। অনুরাগীদের উৎসাহের ঠেলায় রেহাই পাননি পিকাসো-ও। নিউ ইউর্কে ২০১০-এ তাঁর আঁকা একটি ছবির উপর হুমড়ি খেয়ে পড়েন এক মার্কিন মহিলা। সে বার ক্যানভাসে গর্তের আকার ছিল প্রায় ১৫ সেন্টিমিটার। সেটিকেও পুনরুদ্ধার করা হয়। পাক্কা তিন বছর পর, ২০১৩-য় সেটি নিলামে ওঠে। বিক্রয়মূল্য— হাজার কোটি ছাপিয়ে! সেটিও এক রেকর্ড বটে।