সেই স্ট্র্যাটফোর্ড-আপ্ন-আভন। যেখানে জন্মেছিলেন শেক্সপিয়র। সেখান থেকে গাড়িতে বড়জোর মিনিট চল্লিশের পথ। গ্লসেস্টারশায়ারের ছোট্ট একটা গ্রাম কাইনটন। পাহাড়ে ঘেরা সেই ছোট্ট গ্রামে বাইরে থেকে হঠাৎ কেউ গেলে, এখনও তার ঘরে ঘরে কার্পণ্য থাকে না আতিথেয়তায়। কেউ না কেউ বেরিয়ে আসবেনই ঘর ছেড়ে। নিয়ে যাবেন তাঁদের বাড়িতে। বসাবেন। আতিথেয়তা করবেন। আর তার পর তাঁর প্রতিবেশীদের টেলিফোন নম্বর দিয়ে বলবেন, ‘‘আমাকে না পেলে এই নম্বরে অবশ্যই ফোন করবেন। করবেন কিন্তু। ভুলে যাবেন না।’’
ওই গ্রামেই দেখা হয়ে গেল তানিয়া মার্লের সঙ্গে। বেশ কয়েক দশক ধরে চুটিয়ে কাজ করেছেন একটি আন্তর্জাতিক খাদ্য সংস্থার হয়ে। এখন বয়স পঞ্চাশ পেরিয়ে গিয়েছে। একটি ‘পাব’ খুলেছেন পাহাড়-ঘেরা ওই ছোট্ট গ্রাম কাইনটনে। ‘পাব’টার নাম- ‘দ্য হাফ ওয়ে হাউস’। কথাবার্তায় খুব খোলামেলা তানিয়া। কোনও রাখঢাক না রেখে, দু’-চার কথার পরেই তানিয়া জানিয়ে দিলেন, বেশির ভাগ ব্রাইটনের মতোই তিনি তাঁর ভোটটা দিয়েছেন ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) থেকে ব্রিটেনের বেরিয়ে আসার পক্ষে। মানে, এখন যে শব্দটা মানুষের মুখে মুখে ঘুরছে, সেই ‘ব্রেক্সিট’-এর পক্ষে।
কী হাসিখুশি তানিয়া! যেন একটা বড় যুদ্ধে তাঁর জেতা হয়ে গিয়েছে! অথচ, কয়েক ঘণ্টার মধ্যে কত কিছুই না ঘটে গেল! পক্ষে আর বিপক্ষের মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের পর যাঁরা মনেপ্রাণে চেযেছিলেন ব্রিটেন বেরিয়ে আসুক ইইউ থেকে, তাঁরাই জিতে গিয়েছেন। ‘ব্রেক্সিট’ জিতে গিয়েছে প্রায় ৫২ শতাংশ ভোট পেয়ে। আর ব্রিটেনকে ইইউ-তে রাখার মূল প্রবক্তা যিনি ছিলেন, সেই ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন গণভোটের ফলাফল ঘোষণার পর পরই তাঁর ইস্তফা দেওয়ার কথা জানিয়ে দিয়েছেন। পাউন্ডের দাম হুট করে পড়ে গিয়ে গত ৩১ বছরে তা সবচেয়ে নীচে নেমেছে।
কিন্তু তার পরেও তানিয়ার চোখে-মুখে কতই না খুশির ঝিলিক!
তানিয়া বলছিলেন, ‘‘আমি আমার জীবনের বড় একটা সময় ধরে প্রায় গোটা বিশ্ব ঘুরে বেরিয়েছি। প্রচুর মানুষের সঙ্গে পরিচিত হয়েছি। আমি তো অভিবাসনের বিরুদ্ধে ছিলান না কখনও। এখনও নেই। কিন্তু আমাদের কখন খারাপটা লাগত, জান? যখন ব্রাসেলসের (ইইউ-এর প্রশাসনিক জায়গা) লোকজন বলত, তোমরা কী সব ছোট ছোট আনাজ আমাদের বেচ বলো তো? মুখে দেওয়া যায় না! আমার রাগটা কখন হয়, জানেন? যখন ব্রিটেনেরই কেউ কেউ আমাদের বলে, জাতিবিদ্বেষী! যে হেতু আমরা ভোট দিয়েছি ব্রেক্সিটের পক্ষে। খাস লন্ডনের কথা বলছি। লন্ডন আমার খারাপ লাগে, বলছি না। কিন্তু ওখানকার লোকজন কোনও সময়েই বাকি ইংল্যান্ডের কথা ভাবে না। ভাবতে চায়ও না।’’
তানিয়া তার পর আমার হাতে তুলে দিল একটা বই। তার নাম- ‘হোয়াই ভোট লিভ’। লেখক ড্যানিয়েল হান্নান। ওই বইটিতেই পেলাম দু’জনের বক্তব্য। এক জন বরিস জনসন। ক্যামেরনের কনজারভেটিভ পার্টিতে যিনি গোড়া থেকেই ব্রেক্সিটের পক্ষে সওয়াল করে চলেছেন। লন্ডনের প্রাক্তন মেয়র। দেখলাম আরও এক জনের মন্তব্য। তিনি নাইগেল ফারাগে। ব্রেক্সিটের দাবিতে যারা লড়ছে প্রথম থেকেই, সেই ‘ইউনাইটেড কিংডম ইন্ডিপেন্ডেন্স পার্টি’র (ইউকিপ) প্রধান।
তানিয়া ভোটের আগে বেশ কিছু দিন ধরে লন্ডন আর তার আশপাশের গ্রাম-মফস্বলগুলোয় গোরাঘুরি করেছেন। অনেক কিছু দেখেছেন খুব কাছ থেকে। তানিয়া বলছিলেন, ‘‘আমি তো দেখেছি, লন্ডন আর ইংল্যান্ডের অন্যত্র ব্রেক্সিট নিয়ে মানুষের মতামত কতটা আলাদা ছিল। লন্ডনের সর্বত্র ক্যামেরনের সমর্থনে উড়তে দেখেছি নীল পতাকা। আর অন্যত্র, এই গ্রীষ্মে ইংল্যান্ডের গ্রাম-মফস্বলগুলোয় দেখেছি ব্রেক্সিটের সমর্থনে পতপত করে উড়ছে লাল পতাকা।’’
এটা হল কী ভাবে? ভোটের ফলাফলটা এমন হল কী ভাবে?
লন্ডন স্কুল অফ ইকোনমিক্সের অর্থনীতি এ রাজনীতির প্রাক্তন শিক্ষক গৌতম সেন বলছিলেন, ‘‘আসলে প্রবীণ শ্রমিকদের ভোটই সব সমীকরণ উল্টেপাল্টে দিল ক্যামেরনের। বিরোধী দল লেবার পার্টি বরাবরই বিরোধিতা করে এসেছে ইইউ-তে ব্রিটেনের সংযুক্তিকরণের। হালে ওদের প্রচারের পালে খুব জোরে বাতাস বইতে শুরু করেছিল। আর সেটা বইছিল গ্রাম-মফস্বলে লেবার পার্টির সমর্থক শ্রমিক বেল্টের মধ্যেই। ওঁরাই ক্যামেরনের সব হিসেব ওলোটপালোট করে দিলেন।’’
গৌতমবাবু অবশ্য এখানেই থামলেন না। বলে চললেন, ‘‘এটা ঠিকই, ব্রিটেনের সাধারণ মানুষ যা চেয়েছিলেন, সেটাই পেয়ে গিয়েছেন। কিন্তু অন্য প্রশ্নও উঠতে শুরু করেছে। আয়ারল্যান্ডের কী হবে? ওরা তো ইইউ-তে থাকার পক্ষে রায় দিয়েছে। এখনও পর্যন্ত নর্দার্ন আইল্যান্ড আর আয়ারল্যান্ড প্রজাতন্ত্রের মধ্যে সীমানা নিয়ে কোনও বিতর্ক হচ্ছে না। কারণ, ওরা ইইউ-তেই রয়েছে। কিন্তু এ বার তো সেটা আন্তর্জাতিক সীমান্ত হয়ে যাবে। এটা একটা মজার ব্যাপার! ইতিমধ্যেই উত্তর আয়ারল্যান্ডের ডেপুটি ফার্স্ট মিনিস্টার মার্টিন ম্যাকগিনেস আয়ারল্যান্ডের সীমান্তে গণভোটের দাবি জানিয়েছেন।’’
তা হলে কেন ব্রিটেনের মানুষ গণভোটে এমন একটি রায় দিলেন?
গৌতমবাবুর ব্যাখ্যা, ‘‘একটা অনিবার্য সত্যকে তো ব্রিটেনের কোনও নাগরিকই অস্বীকার করতে পারেন না। সেটা হল, এই যে দলে দলে মানুষ ব্রিটেনে আসছিলেন (শুধু গত বছরেই ইইউ-এর বিভিন্ন দেশ থেকে ব্রিটেনে এসেছেন তিন লক্ষ তিরিশ হাজার মানুষ), তার ফলে স্কুল আর সামাজিক সুরক্ষার বিভিন্ন প্রকল্পের ওপর চাপ বাড়ছিল উত্তরোত্তর। চাপ বাড়ছিল এনএইচএসের মতো জাতীয় স্বাস্থ্য সুরক্ষা প্রকল্পের ওপরেও। তাই মানুষ অভিবাসনের বিরুদ্ধে তেতে উঠেছিলেন।’’
ফলাফল ঘোষণার পর এ দিন তাই দু’রকম ছবি উঠে এসেছে মানুষজনের প্রতিক্রিয়ায়। লন্ডনে যাঁরা নামজাদা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোয় কাজ করেন, তাঁরা এই ফলাফলে দারুণ হতাশ। কারণ, এর ফলে তিনি ‘বিশ্বের বাজার’ হারিয়ে ফেলেছেন! লন্ডনের এক জন তো একেবারে মনে রাখার মতো একটা কাজ করে ফেলেছেন! সেটা কী জানেন? ব্রিটেন থেকে লন্ডনকে বের করে আনার দাবি জানিয়ে লন্ডনের একটি আদালতে পিটিশন করে বসেছেন!
কিন্তু লন্ডনের বাইরের ছবিটা একেবারেই অন্য রকম। রাহুল অগ্রবালের সঙ্গে দেখা হল। সাপ্লাই চেন ম্যানেজার। খুব খুশি। কেন? বললেন, ‘‘বাজারে আমার জিনিসের দাম আরও বেশি করে পাব। আমার আরও বেশি লাভ হবে।’’ কিন্তু রাহুলের স্ত্রী রুচি খুশি হননি। রুচি এক জন ফিনান্সার। রুচি বললেন, ‘‘এক সঙ্গে চললেই তো ভাল ছিল। আলাদা হয়ে কী ভালটা হল?’’
আবার ফিরে চলুন সেই কাইনটন গ্রামে। মার্টিন পারচেজের সঙ্গে দেখা হল। একটা হলিডে হোম চালান। তাঁর হলিডে হোমে লোকজন আসত ইইউ দেশগুলো থেকে। পারচেজ ভোটটা দিয়েছিলেন ইইউ-তে থেকে যাওয়ার পক্ষে। কিন্তু পারচেজের বেশির ভাগ প্রতিবেশীই ভোট দিয়েছেন ব্রেক্সিটের পক্ষে। পারচেজ নিজেই জানালেন সে কথা। কেন? পারচেজ বোঝালেন, ‘‘ওঁরা মনে করছিলেন, কেউ যেন ওঁদের মাথায় চেপে বসেছে। আর ওঁদের যেন কোনও ক্ষমতাই নেই! ওঁরা ভাবছিলেন, ওঁদের স্বাতন্ত্র্য নষ্ট হচ্ছে।’’
তার আঁচটা মিলল তানিয়ার কথায়। তানিয়া বলছিলেন, ‘‘যে দিন শুনলাম, মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ইইউ-তে ব্রিটেনের থাকার পক্ষে সওয়াল করছেন, সে দিনই বুঝলাম আমাদের বোকা বানানোর চেষ্টা চলছে। আর তখনই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলাম, ভোটটা ব্রেক্সিটের পক্ষেই দেব।’’
লেখক ‘ফরচুন ইন্ডিয়া’র এডিটর অ্যাট লার্জ।