অপহৃত জুডিথ ডিসুজা (বাঁ দিকে)। মেয়ের চিন্তায়। কলকাতার বাড়িতে জুডিথের মা। ছবি: রণজিৎ নন্দী।
বছরখানেক ধরে কাবুলে কাজ করছিলেন। সমাজসেবাই ছিল ধ্যানজ্ঞান। কলকাতার সেই মেয়ে জুডিথ ডিসুজা-কে বৃহস্পতিবার সন্ধেবেলা কাবুলের রাস্তা থেকে অপহরণ করেছে অজ্ঞাতপরিচয় দুষ্কৃতীরা। শুক্রবার রাত পর্যন্ত তাঁর কোনও খবর মেলেনি। কোনও গোষ্ঠী বা জঙ্গি সংগঠন অপহরণের দায় স্বীকার না করায় পরিস্থিতি নিঃসন্দেহে জটিল। প্রাথমিক ভাবে সন্দেহের তির অবশ্য তালিবানের দিকেই। আফগানিস্তান সরকারের সঙ্গে সর্বক্ষণ যোগাযোগ রেখে চলেছে ভারত। বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ বলেছেন, জুডিথকে ফিরিয়ে আনার জন্য সব রকম চেষ্টা করা হচ্ছে।
কলকাতায় জুডিথের বাড়ি এন্টালির কাছে, সিআইটি রোডে। বৃহস্পতিবার রাত দেড়টা নাগাদ সেখানেই ফোন করে দুঃসংবাদটা জানান কাবুলে ভারতীয় হাইকমিশনার মনপ্রীত ভোরা। এ দিন মনপ্রীত আনন্দবাজারকে বলেন, ‘‘এখনই বলা সম্ভব নয় যে কারা অপহরণ করেছে। এলাকা জুড়ে তল্লাশি চলছে।’’
আফগানিস্তানে এর আগে বেশ কিছু বিদেশিকে অপহরণ করেছে তালিবান়। মার্চ মাসে জালালাবাদে ভারতীয় দূতাবাসে যে জঙ্গি-হানার ঘটনা ঘটে, তার পিছনেও তালিবানের হাত ছিল বলে সন্দেহ করা হয়। তালিবানের হাতে এর আগে কোনও ভারতীয় নাগরিক অপহৃত হয়েছেন বলে মনে করতে পারেননি মনপ্রীত। তিনি জানান, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় এক বন্ধুর বাড়িতে গিয়েছিলেন জুডিথ। নিজের ফ্ল্যাটে ফেরার পথে শহরের মাঝখানে তৈমানি নামে একটি আবাসিক এলাকায় একটি গাড়ি এসে জুডিথের গাড়িকে দাঁড় করিয়ে দেয়। মনপ্রীতের কথায়, ‘‘জুডিথ ও তাঁর গাড়িচালককে নামিয়ে জোর করে তুলে নেওয়া হয় ওই গাড়িতে। কিছু দূর গিয়ে গাড়িচালককে গাড়ি থেকে ফেলে দিয়ে অপহরণকারীরা জুডিথকে নিয়ে পালায়।’’
কলকাতায় যেমন বালিগঞ্জ অথবা আলিপুর অঞ্চল, উত্তর-পশ্চিম কাবুলের তৈমানি ঠিক তেমনই একটা জায়গা। অর্থাৎ শান্তিপূর্ণ আবাসিক এলাকা। ভারতীয় দূতাবাস সংলগ্ন ‘হাই সিকিউরিটি জোন’-এর থেকে অনেকটাই দূরে। সেখানে জুডিথকে কারা কেন অপহরণ করল, তা নিয়ে নির্দিষ্ট করে কিছু বলতে চাননি মনপ্রীত। শুধু বলেন, ‘‘জুডিথ যে সংস্থার হয়ে কাজ করেন, তারাই খবরটা জানায়। পরে কাবুলের প্রশাসনও যোগাযোগ করে।’’
জুডিথের কাজ ছিল মূলত নারী ও শিশুদের অধিকার নিয়ে। আফগানিস্তানের বিস্তীর্ণ এলাকায় তালিবানদের শক্তি এখনও অটুট। মোল্লা হিবাতুল্লা এই মুহূর্তে তালিবান সর্বাধিনায়ক। তালিবানের প্রাক্তন প্রধান মোল্লা ওমর এবং জালালুদ্দিন হাক্কানির ছেলেরা তাঁর ডেপুটি। তাদের কট্টরপন্থী ভাবধারায় মেয়েদের অধিকার ও স্বাধীনতার স্থান নেই। সেই জন্যই কি জুডিথের মতো সমাজসেবীর উপরে তাদের দৃষ্টি পড়ল? সন্দেহটা উড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে না। আবার সাউথ ব্লকের কর্তাদের একাংশের মতে, আফগানিস্তানের উন্নয়নে ভারতের ভূমিকা এবং দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে আঘাত হানার লক্ষ্যেই এ ঘটনা ঘটানো হয়ে থাকতে পারে।
এ মাসের ৪ তারিখেই হেরাতে সালমা বাঁধ উদ্বোধন করে এসেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ভারতীয় অনুদান এবং তদারকিতে নির্মিত এই বাঁধ দু’দেশের বন্ধুত্বের প্রতীক বলে গণ্য। কিন্তু সেটা যে কাবুলে ভারতীয়দের নিরাপত্তার প্রশ্নে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে, এমন ইঙ্গিতও কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা দিয়ে রেখেছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর কাবুল যাত্রার কিছু আগে তাই ভারতীয় দূতাবাসের পক্ষ থেকে সতর্কবার্তা জারি করে বলা হয়েছিল, ‘যে সব ভারতীয় আফগানিস্তানে বসবাস করেন অথবা আফগানিস্তানে সফর করছেন, তাঁদের জন্য এখানকার নিরাপত্তা সংক্রান্ত পরিস্থিতি অত্যন্ত বিপজ্জনক। বিদেশিদের উপর সন্ত্রাসবাদী হামলার ঘটনা লাগাতার ঘটছে এবং ভবিষ্যতে আরও ঘটবে। অপহরণ এবং পণবন্দি করে ফেলার সম্ভাবনাও প্রবল’।
কূটনৈতিক শিবিরে এ কথাও মনে করা হচ্ছে যে, গত বুধবার আমেরিকার মাটিতে দাঁড়িয়ে মোদী যে ভাবে আফগানিস্তানের নাম করে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে কার্যত যৌথ লড়াইয়ের ডাক দিয়েছেন, পরিস্থিতি তাতেও উত্তপ্ত হয়ে থাকতে পারে। সে দিন তালিবানের বিরুদ্ধে মার্কিন যুদ্ধের ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন মোদী। পাশাপাশি বলেছিলেন, লড়াইটা ভারতও লড়ছে, সে দেশের উন্নয়ন এবং শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য। সেই বক্তৃতার পর পরই এই অপহরণের ঘটনা সম্ভবত কাকতালীয় নয় বলেই মনে করা হচ্ছে। তালিবানের সঙ্গে যুদ্ধে কাবুলকে অস্ত্র সরবরাহ করে না বটে দিল্লি। কিন্তু সেখানকার উন্নয়ন, কর্মী প্রশিক্ষণ এবং বিভিন্ন প্রকল্পে নিয়মিত অর্থ বিনিয়োগ করে। আফগানিস্তানের পুনর্গঠনে সক্রিয় ভূমিকা নেয়। সেটা কি তবে ব্যুমেরাং হল? আফগানিস্তানের প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত বিবেক কাটজুর মতে, সাহায্যের অঙ্ক কমানোটা কাম্য নয়। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতিটা মাথায় রেখে প্রকল্প বাছাই করা উচিত। ছোট ছোট প্রকল্প হাতে নিয়ে ধীরে এগোনোটাই বুদ্ধিমানের কাজ।
জুডিথ যে সংস্থাটির হয়ে কাজ করতে কাবুলে গিয়েছিলেন, তার নাম আগা খান ফাউন্ডেশন। সেটি একটি আন্তর্জাতিক এনজিও— আগা খান ডেভেলপমেন্ট নেটওয়ার্ক (একেডিএন)-এর শাখা সংস্থা। একেডিএন-এর চেয়ারম্যান আগা খান বংশানুক্রমিক ভাবে ইমাম হন ১৯৫৭ সালে। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামিক ইতিহাসের এই স্নাতক বরাবরই সহিষ্ণুতা এবং সহমর্মিতার প্রচার করে এসেছেন। আফগানিস্তানে তাঁর সংস্থার সঙ্গে স্বার্থের সংঘাত রয়েছে, এমন গোষ্ঠীর সংখ্যাও কম নয়। ফলে এই অপহরণ আগা খানকে সবক শেখানোর জন্য কিনা, সেটাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
শুক্রবার দুপুরে তৃণমূলের রাজ্যসভার সাংসদ ডেরেক ও’ব্রায়েন ফোন করে জুডিথের দিদি অ্যাগনেস ও বাবা ডেনজিল ডিসুজার সঙ্গে কথা বলেন। বিদেশমন্ত্রীকে বিষয়টি তিনি জানান। পরে সুষমাও টুইট করে জানান, জুডিথের পরিবারের সঙ্গে তাঁর কথা হয়েছে। দেশের মেয়েকে দেশে ফেরানোই তাঁর অগ্রাধিকার।