রাজারত্নম ও রজত গুপ্ত
টেবিলে সামান্য ঝুঁকে যখনই কিছু বলেছেন, বরাবর তা কান খাড়া করে শুনেছে কর্পোরেট দুনিয়া। অথচ এখন সেই সামান্য ঝুঁকেই মার্কিন মুলুকের জেলে টেবিল মুছছেন রজত গুপ্ত! সেই জেল, যেখানে কিছু দিন আগেও বন্দি ছিলেন বস্টন ম্যারাথনে বিস্ফোরণ ঘটানো ঝোখর সারনায়েভ।
ডেভিড মর্গ্যান নামে এক সঙ্গি বন্দির বয়ান অনুযায়ী, দু’বছরের জেল খাটার শাস্তিকে নিয়তি বলেই মেনে নিয়েছেন উপদেষ্টা বহুজাতিক ম্যাকিনসের প্রাক্তন কর্ণধার। কর্পোরেট দুনিয়ায় ভারতীয়দের এক সময়ের এই ‘পোস্টার বয়’-এর এখন দিন কাটে জেলের কুঠুরিতে সেঁটে রাখা বৌ-মেয়ের ছবির দিকে তাকিয়ে। খুশি বলতে মেয়ে আর নাতনিদের দেখা করতে আসা। আর অস্বস্তি? সম্ভবত ওই একই জেলে ‘পুরনো বন্ধু’ রাজ রাজারত্নমের সঙ্গে দেখা হয়ে যাওয়া।
আইআইটি-দিল্লি ও হার্ভার্ড বিজনেস স্কুলের প্রাক্তনী রজতবাবুর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তাঁর কাছে পাওয়া গোপন তথ্য কাজে লাগিয়েই বেআইনি ভাবে শেয়ার কেনা-বেচায় বিপুল মুনাফা করেছে হেজ ফান্ড সংস্থা গ্যালিয়ন। যার প্রতিষ্ঠাতা ও প্রাক্তন কর্ণধার শ্রীলঙ্কার মার্কিন প্রবাসী রাজারত্নম। ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্ক গোল্ডম্যান স্যাক্সের পরিচালন পর্ষদে থাকাকালীন সেখানে ওয়ারেন বাফের সংস্থার ৫০০ কোটি ডলার লগ্নির সিদ্ধান্ত রাজারত্নমকে আগাম জানিয়ে দিয়েছিলেন রজতবাবু। ওই ঘটনার পরে দু’বছরের সাজা হয়েছে তাঁর। আর রাজারত্নমের ভাগ্যে জুটেছে ১১ বছরের জেল।
দীর্ঘদিন ডায়াবেটিসের শিকার রাজারত্নম অধিকাংশ সময়ই থাকেন জেলের হাসপাতালে। জেল একই হলেও দু’জনের কুঠুরি আলাদা। তবু কখনও-সখনও তাঁদের দেখা হয়ে যায় খাওয়ার ঘরে কিংবা চলাফেরার জায়গায়। ডেভিডের দাবি, ‘‘বড়জোর কেঠো সৌজন্য বিনিময়। তার বেশি কথা হয় না।’’ মামলা চলার সময় থেকেই দু’জনের সম্পর্ক তলানিতে। এক সময় সেরা সব হোটেল আর রেস্তোরাঁয় বসে কথা বলা দুই ‘বন্ধু’র তেমন কথা হয়তো আর বাকি নেই।
ডেভিডের দাবি, নিজেকে গুটিয়েও নিয়েছেন রজতবাবু। তাঁর কথায়, ‘‘জেলে অনেকে ওঁকে জিজ্ঞাসা করেন, কোন শেয়ার কিনব। উত্তর আসে, আমি এ নিয়ে কিছু জানি না! অনেকে জানতে চান, ব্যবসা শুরুর কৌশল। উত্তর মেলে, আমি ওই দুনিয়ার বাইরে।’’ অথচ সেই রজতবাবুই না কি মর্গ্যানের সঙ্গে প্রাণ খুলে গল্প করেছেন। ভাগ করে খেয়েছেন আইসক্রিম। হাত দিয়েছেন বই লেখায়। ডেভিড প্রায় সম্মোহিত।
প্রায় সাড়ে তিন দশকের বর্ণময় কেরিয়ারে রজতবাবুর সাফল্য চোখধাঁধানো। সমাজের উঁচু মহলে তাঁর বরাবরের পরিচিতি ‘পারফেক্ট জেন্টলম্যান’ হিসেবে। তাঁর জেলযাত্রা আটকাতে আবেদন জানিয়েছিলেন মুকেশ অম্বানী থেকে বিল গেটস। অথচ জেলে সেই রজতবাবুকেই কড়া শাস্তি হিসেবে আরও ‘অন্ধকার’ কুঠুরিতে যেতে হয়েছে দু’বার। এক বার পিঠের ব্যথা সামাল দিতে বাড়তি বালিশ নেওয়ার অপরাধে। আর এক বার নাম ডাকার সময় উঠে দাঁড়াননি তিনি। জুতোর ফিতে বাঁধছিলেন।
৬৬ বছরের রজতবাবুর চোখ চকচক করে শুধু শুক্রবার। দুই নাতনি দেখা করতে এলে।