সৈকতে মৃত্যুর থাবা। তিউনিসিয়ায় ভূমধ্যসাগরের পাড়ে সুসা শহরের এক রিসর্টে। শুক্রবার। ছবি: রয়টার্স।
কালো শুক্রবার। নাকি সন্ত্রস্ত শুক্রবার।
সন্ত্রাসবাদী হানায় একই সঙ্গে বিধ্বস্ত তিন মহাদেশের তিন প্রান্ত।
আফ্রিকা, এশিয়া, ইউরোপ। তিউনিসিয়া, কুয়েত, ফ্রান্স। তিন দেশে একই দিনে পরপর জঙ্গি হামলায় আজ প্রাণ গিয়েছে মোট ৬৫ জনের।
আজ দুপুরে তিউনিসিয়ায় জনপ্রিয় সৈকত-শহর সুসার দু’টি রিসর্টে দুই বন্দুকবাজের হামলায় মৃত্যু হয়েছে বিভিন্ন দেশের পর্যটক-সহ ৩৭ জনের। সরকারি সূত্রে খবর, আহত কমপক্ষে বারো জন।
আত্মঘাতী হামলা চলেছে কুয়েতের রাজধানী কুয়েত সিটির এক মসজিদেও। রমজান মাসে শুক্রবারের প্রার্থনা উপলক্ষে তখন সেখানে জড়ো হয়েছিলেন হাজারখানেক মানুষ। বিস্ফোরণে নিহত হন ২৭ জন।
আহত শতাধিক।
দক্ষিণ ফ্রান্সের এক গ্যাস কারখানায় জোর করে গাড়ি ঢুকিয়ে বিস্ফোরণের চেষ্টা করে কয়েক জন আততায়ী। কোনও বিস্ফোরণ না হলেও কারখানা চত্বর থেকে উদ্ধার হয়েছে একটি কাটা মুন্ডু। যার পাশেই রাখা ছিল আরবি ভাষায় লেখা একটি পতাকা। এই ঘটনায় আহত হন দু’জন।
শুক্রবার রাত পর্যন্ত একমাত্র কুয়েতের হামলাটিরই দায় নিয়েছে ইসলামিক স্টেট (আইএস)-এর সহযোগী এক জঙ্গি গোষ্ঠী। তিউনিসিয়া ও ফ্রান্সে কেউ দায় স্বীকার না করলেও সন্দেহের তির আইএসের দিকেই। কারণ, এই দুই দেশেই কিছু দিন আগে বড় মাপের হামলা চালিয়েছিল আইএস জঙ্গিরা। দুনিয়া জুড়ে অস্তিত্ব জানান দিতে তারাই এক দিনে ৩ মহাদেশে হামলা চালাল কি না, তা খতিয়ে দেখছেন গোয়েন্দারা।
তিউনিসিয়ার রাজধানী তিউনিস থেকে দেড়শো কিলোমিটার দূরে সুসা। এ শহরের প্রধান আকর্ষণই তার সমুদ্রসৈকত। সারা বছর লেগে থাকে বিদেশি পর্যটকের ভিড়। সমুদ্রের ধার ঘেঁষে সার দিয়ে চার ও পাঁচ তারা হোটেল-রিসর্ট। অন্য দিনের মতো আজও সৈকতে সূর্যস্নান করছিলেন পর্যটকেরা। বেলা তখন বারোটা হবে। হঠাৎ গুলির আওয়াজ। দেখা যায়, দু’টি রিসর্টে কালাশনিকভ হাতে ঢুকে পড়েছে দুই বন্দুকবাজ। এলোপাথাড়ি গুলি চালাচ্ছে তারা।
শুরু হয় চিৎকার আর পালানোর জন্য হুড়োহুড়ি। পর্যটকদের কেউ কেউ সমুদ্রসৈকতেই তাঁবু বা কাপড়ের আড়ালে লুকোনোর চেষ্টা করেন। তত ক্ষণে চলে এসেছেন বিভিন্ন হোটেল ও রিসর্টের নিজস্ব নিরাপত্তারক্ষীরা। এসে পড়ে পুলিশও। বন্দুকবাজদের সঙ্গে তাদের গুলিযুদ্ধ চলে বেশ কিছু ক্ষণ। তত ক্ষণে অবশ্য লুটিয়ে পড়েছেন বেশ কয়েক জন পর্যটক। শেষমেশ এক বন্দুকবাজকে মেরে ফেলে পুলিশ। পালিয়ে যায় অন্য জন। তিউনিসিয়ার অভ্যন্তরীণ মন্ত্রকের খবর অনুযায়ী, আজকের হামলায় প্রাণ হারিয়েছেন মোট ৩৭ জন। নিহতদের তালিকায় ব্রিটেন, বেলজিয়াম আর জার্মানির নাগরিকেরা যেমন রয়েছেন, তেমনই আছেন তিউনিসিয়ার কিছু মানুষও।
অভ্যন্তরীণ মন্ত্রকের মুখপাত্র মহম্মদ আলি আরুই জানান, এই ঘটনাকে জঙ্গি হানা বলেই মনে করছেন তাঁরা। চলতি বছরের মার্চেই এক দল জঙ্গি হানা দিয়েছিল তিউনিসের জাদুঘরে। আইএস অবশ্য সে ঘটনার দায় স্বীকার করেছিল। তাদের হামলায় সে বার প্রাণ গিয়েছিল ২১ জন বিদেশি পর্যটকের। আজকের হামলা নিজের চোখে দেখেছেন গ্যারি পেইন নামে এক ব্রিটিশ পর্যটক। সংবাদমাধ্যমের কাছে পরে তিনি বলেন, ‘‘প্রথমে ভাবলাম বাজি ফাটছে। পর্যটকদের ভয়ে ছোটাছুটি করতে দেখে বুঝতে পারি, গুরুতর কিছু হয়েছে।’’ গ্যারির
দাবি, গুলির পাশাপাশি বিস্ফোরণের আওয়াজও শুনেছেন তিনি। তবে সে কথা সরকারি ভাবে স্বীকার করা হয়নি। অন্য কয়েক জন প্রত্যক্ষদর্শী জানাচ্ছেন, পর্যটকের ছদ্মবেশেই এসেছিল হামলাকারীরা। তাই প্রথমে দেখে বোঝাই যায়নি, মুহূর্তে এত বড় হামলা চালাবে তারা।
সন্ত্রাসের আগাম আঁচ পাননি কুয়েত সিটির শিয়া মসজিদে শুক্রবারের প্রার্থনা করতে আসা হাজারখানেক মানুষও। সেখানেও হামলার সময় দুপুর ১২টা। আত্মঘাতী বিস্ফোরণে নিজেকে উড়িয়ে দেয় বছর তিরিশের এক যুবক। হামলার দায় যারা নিয়েছে, তারা সৌদি আরবের আইএস সমর্থিত একটি গোষ্ঠী। শিয়া মুসলিমদের বরাবরই নিজেদের শত্রু বলে মনে করে আইএস। ইরাক বা সিরিয়া, সৌদি আরব বা ইয়েমেনে এর আগে শিয়া মুসলিমদের উপরে হামলা হলেও কুয়েতের মতো দেশে এর আগে এত বড় হামলা চালায়নি আইএস বা তাদের সহযোগী কোনও গোষ্ঠী। রমজান মাসের প্রথমেই এত বড় হানায় স্বভাবতই আতঙ্কিত কুয়েতের মানুষ। যাঁরা প্রাণে বেঁচেছেন, তাঁদের কেউ কেউ কেউ জানাচ্ছেন, আত্মঘাতী ওই জঙ্গিকে সন্দেহজনক ভাবে মসজিদ চত্বরে ঘোরাফেরা করতে দেখেছিলেন তাঁরা। কিছু ক্ষণের মধ্যে সে-ই নিজেকে বিস্ফোরণে উড়িয়ে দেয়। কুয়েতের অভ্যন্তরীণ মন্ত্রক জানিয়েছে, এই বিস্ফোরণে মৃত্যু হয়েছে ২৭ জনের। আহত কমপক্ষে ২০২ জন। বিস্ফোরণে ভয়ানক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মসজিদটিও।
ফ্রান্সে হামলা প্রায় সাতসকালে। ক্ষয়ক্ষতির বহরটা অন্য দুই দেশের চেয়ে কম হলেও দেশজুড়ে আতঙ্কের স্রোত বইয়ে দিয়েছে। তার একটা কারণ যদি ‘শার্লি এবদো’ পত্রিকার দফতরে আইএস হানার স্মৃতি হয়, তা হলে অন্যটা হল এ দিন ঘটনাস্থলে উদ্ধার হওয়া একটি কাটা মুন্ডু।
দক্ষিণ-পূর্ব ফ্রান্সের সঁ কোয়াতঁ ফ্যালভিয়ে শহরের এক গ্যাস কারখানায় আজ একটি গাড়ি তীব্র গতিতে ঢুকে পড়ে গ্যাস ট্যাঙ্কারের গায়ে ধাক্কা মারার চেষ্টা করে। পুলিশের সন্দেহ, আততায়ীদের উদ্দেশ্য ছিল বড় বিস্ফোরণ ঘটানো। শেষ পর্যন্ত তা অবশ্য পারেনি তারা। ঘটনাস্থল থেকেই ধরা হয়েছে এক জনকে। তবে হামলাকারীরা সংখ্যায় ঠিক কত জন ছিল, তা নিয়ে ধোঁয়াশা রয়েছে। যাকে ধরা হয়েছে, তার নাম ইয়াসিন সালহি। ৩৫ বছরের সালহি ফরাসি নাগরিক। গ্রেফতার করা হয়েছে তার স্ত্রীকেও। কারখানা চত্বর উদ্ধার হওয়া ছিন্নমুণ্ডটির পাশেই পড়ে ছিল আরবি ভাষা লেখা পতাকাটি।
মুণ্ডটি কার, এখনও স্পষ্ট নয়। তবে তদন্তকারীরা মনে করছেন, নিহত ব্যক্তি ওই কারখানায় কোনও মাল সরবরাহের জন্য এসেছিলেন। কেন, কী ভাবে তাঁকে মারা হয়েছে, তা নিয়ে এখনও ধন্দে পুলিশ। ব্রাসেলসে ইউরোপীয় ইউনিয়নের শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে গিয়েছিলেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওলাঁদ। হামলার খবর পেয়েই সফর কাটছাঁট করে দেশে ফিরে যান তিনি। সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে ওলাঁদ বলেছেন, ‘‘বোঝাই যাচ্ছে বিস্ফোরণের জন্যই এমন ছক কষা হয়েছিল। এটা নিঃসন্দেহে জঙ্গি হামলা।’’ হামলার ধরন দেখে আইএস-কেই সন্দেহ করছেন তদন্তকারীরা। কিন্তু কোনও জঙ্গি গোষ্ঠী দায় স্বীকার না করায় তাঁদের কাজটা কঠিন হয়েছে।
আইএস নিধনে আন্তর্জাতিক জোটের অন্যতম সদস্য ফ্রান্স। ফলে বরাবরই এই দেশকে নিশানা করেছে ওই জঙ্গি সংগঠন। জানুয়ারিতে শার্লি এবদো কাণ্ডের পরে গোটা দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থা আঁটোসাঁটো করেছিল ফরাসি পুলিশ। কয়েক মাসে বেশ কয়েকটি নাশকতার ছক বানচালও করেছে তারা। কিন্তু তা-ও যে যথেষ্ট ছিল না, আজকের ঘটনা তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল।
বিশ্বজুড়ে হামলার তীব্র নিন্দা করেছেন রাষ্ট্রপুঞ্জের মহাসচিব বান কি মুন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী টুইটারে লিখেছেন, ‘‘এই কাপুরুষোচিত হামলায় যাঁরা প্রাণ হারিয়েছেন, তাঁদের পরিবারের জন্য সমবেদনা। ভ্রাতৃত্ব, শান্তি আর অহিংসাতেই মনুষ্যত্বের উন্নতি। ঘৃণা, সন্ত্রাস আর হিংসায় নয়।’’