আমেরিকার স্বাধীনতা দিবস। বেশ কয়েক দিন ধরেই তা নিয়ে সাজ সাজ রব দেশটায়। বৃহত্তম শহর নিউ ইয়র্কে যে সেই রব আরও বেশি করে থাকবে, তা বোঝার জন্য নিউ ইয়র্কে আসতে হয় না।
কিন্তু এখানেই রয়েছে দৃশ্যপটের মোচড়টা।
স্বাধীনতা দিবসের উদযাপন উপলক্ষে নিউ ইয়র্কে এখন শোরগোল বেশি, নাকি বঙ্গ সম্মেলন উপলক্ষে, স্থানীয় মানুষের পক্ষেও তা বোঝা শক্ত হয়ে যাচ্ছে। রবিবার তেমনই ঘটনা ঘটতে দেখা গেল।
রবিবারই ছিল তিন দিনের বঙ্গ সম্মেলনের শেষ দিন। স্বাভাবিক ভাবেই দশমীর বিষাদ এ শহরে জড়ো হওয়া বাঙালিদের মধ্যে। তবে সে বিষাদে কোথাও ভাঙা হাটের মেজাজ নেই। শেষ পাতটা নিঃশেষে চেটেপুটে নেওয়ার হুজুগে আরও জমজমাট ম্যানহাটান। মূল ভেন্যু ম্যাডিসন স্কোয়্যার গার্ডেনে রবিবার ছিল সুনিধি চৌহানের অনুষ্ঠান। সুনিধির গান শুনতে গোটা উত্তর আমেরিকার বাঙালিকুল ভেঙে পড়ল ম্যানহাটানে। ম্যাডিসন স্কোয়ার গার্ডেনের বাইরে সে এক বিপুল লম্বা লাইন। চরিত্রে আদ্যন্ত কসমোপলিটন শহরটাও এত বড় বাঙালি সমাবেশ দেখে বেশ একটু আশ্চর্যই! স্থানীয় মার্কিনদের অনেককেই দাঁড়িয়ে পড়তে দেখলাম। চোখে জিজ্ঞাসা, কী ব্যাপার? এত ভিড় কেন ম্যাডিসনে? কে আসছেন? কে আসছেন, তা জেনেও কিন্তু ঘোর কাটছে না অনেকেরই। বাঙালিদের সম্মেলন উপলক্ষে ভারতীয় প্লে-ব্যাক সিঙ্গারের গান শুনতে ম্যানহাটানে এমন আশ্চর্য ভিড় জমতে পারে, তা আগে জানা ছিল না আমেরিকার।
আয়োজক এনএবিসি’র তরফ থেকে ‘বিশ্বের সেরা বাঙালি’ হিসেবে এ দিন সম্মানিত করা হল কালীপ্রদীপ চৌধুরীকে। কলকাতার ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজের এই মেধাবী ছাত্র কয়েক দশক আমেরিকায়। অর্থোপেডিক সার্জেন কালীপ্রদীপ উত্তর আমেরিকায় এখন সবচেয়ে প্রভাবশালী বাঙালিদের অন্যতম। এত বছর ক্যালিফোর্নিয়ায় কাটিয়েও কিন্তু এখনও আপাদমস্তক বাঙালি তিনি। স্বভাবে, আচরণে বাঙালিয়ানাটা এখনও বেশ দাপটে রাজত্ব করছে। মার্কিন মুলুকে কতটা প্রতিপত্তি করতে পেরেছেন, তা নিয়ে খুব বেশি ভাবিত নন। অনেক বেশি আপ্লুত ‘বিশ্বের সেরা বাঙালি’ শিরোপা পেয়ে। কারণ, কালীপ্রদীপ চৌধুরী এখনও নিজের বাঙালি পরিচয়টাই সর্বাগ্রে দেন। তার পর ভারতীয়ত্ব, তার পর বিশ্বজনীনতা।
সেরা বাঙালির পুরস্কার পেলেন কালীপ্রদীপ চৌধুরী।
বঙ্গ সম্মেলনের শেষ দিনেও অনুষ্ঠান চলল সব ক’টা ভেন্যুতেই। সুজয়প্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, কৌশিক সেন, রায়া ভট্টাচার্যেরা আবৃত্তি, শ্রুতিনাটকে মন ভরিয়ে দিলেন। তিন দিন ধরেই দেখলাম, কালিকাপ্রসাদ আর তাঁর দোহার ব্যান্ড বেশ জনপ্রিয় এখানে। যখন, যেখানে অনুষ্ঠান করছেন, সেখানেই ভিড় হচ্ছে। শেষ দিনেও একই ছবি।
এই সব কিছুর বাইরে বিষাদের সুরটা কিন্তু বাজছেই। একটু সুযোগ পেলেই হানা দিচ্ছে এই বঙ্গ সম্মেলনে অংশ নেওয়া প্রায় প্রত্যেক বাঙালির মনে। অনেক দিন পর পরস্পরের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। অনেক দিন পর টানা কয়েকটা দিন নিজের লোকজন, নিজের ভাষা, নিজের সংস্কৃতির মাঝে কাটানোর সুযোগ হয়েছিল। আবার কবে দেখা হবে অনিশ্চিত। কেউ রবিবারই নিউ ইয়র্ক ছাড়ছেন। কারও ফেরার টিকিট সোমবারে। তাই শেষ দিনে সবার সঙ্গে আবার একটু দেখা করে নেওয়ার পালা। একটু আলিঙ্গন, একটু হাত মেলানো, একটু আবার দেখা করার প্রতিশ্রুতি।
আগামী বছর বঙ্গ সম্মেলন সান ফ্রান্সিসকোয়। ঘোষণা হয়ে গেল ম্যাডিসন স্কোয়ারেই। বেলা শেষের সেই ঘোষণায় সব বাঙালির মনে যেন অকাল বিজয়া দশমী— আসছে বছর আবার হবে।
আরও পড়ুন, চিকেন-ভাত হাতে নিয়েই সোজা ফিল্ম উৎসবে, বঙ্গ সম্মেলন জমজমাট