Fidel Castro

ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি ফিদেলের ছিল গভীর শ্রদ্ধা

কালপুরুষ ফিদেল কাস্ত্রো চলে গেলেন। গত এপ্রিলে হাভানা কনভেনশন সেন্টারে, কিউবার কমিউনিস্ট পার্টির জাতীয় সম্মেলনে দেওয়া বক্তৃতায় ফিদেল বলেছিলেন, “হয়তো এই শেষ বারের মতোই আমি এই মঞ্চে বক্তৃতা করছি।’’

Advertisement

প্রসেনজিৎ বসু

শেষ আপডেট: ২৬ নভেম্বর ২০১৬ ১৯:০০
Share:

দমদম বিমানবন্দরে ফিদেল কাস্ত্রো। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ থেকে।

কালপুরুষ ফিদেল কাস্ত্রো চলে গেলেন। গত এপ্রিলে হাভানা কনভেনশন সেন্টারে, কিউবার কমিউনিস্ট পার্টির জাতীয় সম্মেলনে দেওয়া বক্তৃতায় ফিদেল বলেছিলেন, তাঁর ৯০ বছর বয়স হতে চলেছে, সময় ফুরিয়ে এসেছে, “হয়তো এই শেষ বারের মতোই আমি এই মঞ্চে বক্তৃতা করছি।” ফিদেল আরও বলেছিলেন যে তিনি না থাকলেও, কিউবার কমিউনিস্টদের যে চিন্তন এবং অবদান, তা গোটা দুনিয়ার সামনে এই সাক্ষ্য বহন করবে যে, উদ্দীপনা ও আত্মসম্মান নিয়ে যদি পরিশ্রম করা যায়, তা হলে মানুষের বস্তুগত ও সাংস্কৃতিক চাহিদা অবশ্যই মেটানো সম্ভব।

Advertisement

ফিদেলের সারা জীবনই উৎসর্গিত ছিল তাঁর দেশ কিউবা তথা দুনিয়ার তামাম শোষিত, নিপীড়িত মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণে। সেটাই যে বিপ্লবী বাম রাজনীতির মূল উদ্দেশ্য, চলে যাওয়ার আগে সেই কথাটা স্মরণ করিয়ে দিতে ভুলে যাননি তিনি।

গত শতাব্দীর শেষ দুই দশক জুড়ে যখন সোভিয়েত রাশিয়া সমেত অন্য সাবেক সমাজতান্ত্রিক দেশগুলির একের পর এক পতন ঘটেছে, নয়া উদারবাদী বিশ্বায়নের ঢেউয়ে ভেসে গেছে একের পর এক দেশ, তখন স্রোতের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে, আত্মবিশ্বাস এবং বলিষ্ঠতা নিয়ে যে বিকল্পের আওয়াজটা উঠেছিল লাতিন আমেরিকা থেকে, ‘হয় সমাজতন্ত্র নয় মৃত্যু’— তার প্রাণকেন্দ্রে ছিলেন ফিদেল। নয়া উদারবাদী বিশ্বায়ন যে বাড়িয়ে তুলবে ধনী-দরিদ্রের মধ্যেকার বিভাজন, বিপর্যস্ত করবে আমাদের প্রকৃতি-পরিবেশকে, জন্ম দেবে বিশ্বজুড়ে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন-সন্ত্রাসবাদ-হিংসার, পৃথিবীর প্রথম সারির নেতাদের মধ্যে সে কথা প্রথম বলেছিলেন ফিদেলই। উগো সাভেজ বা ইভো মোরালেসের মতো ২১ শতকের সমাজতান্ত্রিক নেতাদের অনুপ্রেরণা ছিলেন তিনিই।

Advertisement

ইন্দিরা গাঁধীর সঙ্গে ফিদেল কাস্ত্রো।

পুঁজিবাদ শেষ কথা বলবে না, এই কথা যেমন ফিদেল সোচ্চারে বলেছেন, তেমন ভাবেই তিনি বিগত শতকের সমাজতান্ত্রিক দেশগুলির ভুলভ্রান্তি সম্বন্ধেও ছিলেন সচেতন। সাভেজ বা মোরালেসকে তিনি কখনওই পরামর্শ দেননি তাঁদের দেশে এক-পার্টির একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে। বরং বলেছেন আরও ব্যাপক আকারে গণতন্ত্রের প্রসার ঘটাতে, সাধারণ মানুষের অধিকারবোধ এবং সচেতনতা বৃদ্ধিতে জোর দিতে। কিউবা থেকে শ’য়ে শ’য়ে ডাক্তার পাঠিয়েছেন ভেনেজুয়েলা বা বলিভিয়াতে গরিব মানুষের বিনা পয়সায় চিকিৎসা করতে। শুধু লাতিন আমেরিকায় নয়, আফ্রিকা ও এশিয়ার বহু দেশে, এমনকী ২০০৫-এর ভয়াবহ ভূমিকম্পের পরে পাকিস্তানেও, কিউবার ডাক্তাররা এসে দুঃস্থ-আক্রান্ত মানুষের চিকিৎসা করে গেছেন। জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে বিশ্বের সমস্ত গরিব দেশ এবং শোষিত মানুষের পাশে দাঁড়ানো, এই ছিল ফিদেলের আন্তর্জাতিকতাবাদ এবং মানবিকতাবাদ।

আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী নীতি এবং চোখরাঙানির বিরুদ্ধে বুক চিতিয়ে লড়েছেন সারা জীবন। আমেরিকার দশ জন রাষ্ট্রপতি এসেছেন, চলেও গেছেন। সেই ১৯৬১-র বে-অফ-পিগস আগ্রাসন থেকে পরবর্তী কালের সিআইএ-র হত্যার চক্রান্ত, কোনও কিছুই হারাতে পারেনি ফিদেলকে। ওবামার ডাকে সারা দিয়ে কিউবা-আমেরিকার সম্পর্ক স্বাভাবিক করার পদক্ষেপকে সমর্থন করেছেন দেশের অর্থনীতির স্বার্থে, কিন্তু আমেরিকাকে মনে করিয়ে দিয়েছেন যে এর মানে আত্মসমর্পণ নয়, সম্মানজনক সহাবস্থান।

অনেকেরই হয়তো জানা নেই, ফিদেল কাস্ত্রো প্রথম জীবনে কমিউনিস্ট ছিলেন না। হাভানা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনের স্নাতক ফিদেল, তাঁর দেশের স্বৈরাচারী শাসক ব্যতিস্তার বিরুদ্ধে প্রথমে আইনি লড়াইয়ের চেষ্টা করেছিলেন। আইনি পথে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সমস্ত সম্ভাবনা নিঃশেষ হয়ে যাওয়ায় বাধ্য হয়ে সশস্ত্র সংগ্রামের পথ ধরেন কাস্ত্রো— ২৬ জুলাই, ১৯৫৩-তে তাঁর নেতৃত্বে সশস্ত্র বিপ্লবীরা আক্রমণ করে মনকাডা গ্যারিসন। সেই অভিযান অসফল হলেও, সেই ‘২৬ জুলাই মুভমেন্ট’-এর স্ফূলিঙ্গ কিউবার জনগণের মধ্যে স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের বার্তা ছড়িয়ে দেয়। গ্রেফতার হয়ে জেলে থাকা অবস্থায় ফিদেল শুরু করেন মার্কসবাদ নিয়ে পড়াশোনা।

পরবর্তী সময়ে মেক্সিকোতে গিয়ে গেরিলা বাহিনী তৈরি করে, চে গেভারা, রাউল কাস্ত্রোদের মতো ৮১ জন বিপ্লবীকে নিয়ে গ্রানমা নামের নৌযানে করে কিউবাতে ফেরেন ১৯৫৬-তে। দু’বছর সশস্ত্র সংগ্রাম চালানোর পর, ১৯৫৮-র ৩১ ডিসেম্বর স্বৈরাচারী ব্যতিস্তা কিউবা ছেড়ে পালিয়ে যান। ক্ষমতা দখল করে ফিদেলের গেরিলা বাহিনী। এর পর ব্যতিস্তার সমর্থনে আমেরিকা বার বার চেষ্টা করে ফিদেলকে হঠানোর। এর ফলে সোভিয়েত ইউনিয়নের সাহায্য নিতে বাধ্য হন ফিদেল। পরবর্তী কালে ফিদেলের দল কমিউনিস্ট পার্টি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।

বিমানবন্দরে ফিদেল কাস্ত্রোকে স্বাগত জানাচ্ছেন অশোক ঘোষ, জ্যোতি বসু, প্রমোদ দাশগুপ্ত, সুবোধ বন্দ্যোপাধ্যায় (বাঁ দিক থেকে)।

ঠাণ্ডা যুদ্ধের দশকগুলিতে যখন বিভিন্ন সমাজতান্ত্রিক দেশের নেতৃত্ব সোভিয়েত ইউনিয়নের লেজুড়বৃত্তি করেছে, ফিদেল কিন্তু সেই পথে হাঁটেননি। বরং আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে কিউবা এবং ফিদেলের কণ্ঠ ছিল একটি স্বাধীন, বিকল্প কণ্ঠস্বর, যা ছিল তৃতীয় বিশ্বের শোষিত, নিপীড়িত জনগণের স্বার্থের প্রশ্নে অবিচল। জোট নিরপক্ষে আন্দোলনের এক গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ।

শোষিত মানুষের স্বার্থের প্রতি অবিচল থাকলেও তিনি যে গোঁড়ামিতে বিশ্বাস করতেন না, তা বোঝা যায় সাম্প্রতিক কালে ধর্ম বা সমকামিতার প্রশ্নে ফিদেলের পুনর্মূল্যায়নে। ফিদেলের মার্কসবাদ ছিল যথার্থই সৃজনশীল, যা নতুন করে কোনও বিষয়কে দেখতে বা ভাবতে ভয় পায়নি।

ভারতের জনগণের প্রতি ফিদেল কাস্ত্রোর ছিল বিশেষ উষ্ণতা, আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি ছিল তাঁর গভীর শ্রদ্ধা। শোনা যায়, ২০০৬-এ হাভানায় ‘নাম’ শীর্ষ সম্মেলনের সময় ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের সঙ্গে তিনি যখন দেখা করেন, তখন খাদ্যে স্বনির্ভরতা অর্জন করার এত দশক পরে কেন ভারতকে গম আমদানি করতে হচ্ছে, এই প্রশ্ন তিনি করেছিলেন।

নয়া উদারবাদী বিশ্বায়নের প্রক্রিয়া যখন আজ সঙ্কটাচ্ছন্ন, অথচ খেটে খাওয়া মানুষের ক্ষোভ, হতাশাকে কাজে লাগিয়ে দেশে দেশে উত্থান ঘটছে চরম দক্ষিণপন্থী শক্তিগুলির, তখন ফিদেলের জীবন-দর্শন বামপন্থীদের কাছে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক।

কমান্দান্তে ফিদেল কাস্ত্রো অমর রহে!

আরও পড়ুন:

ফিদেল কাস্ত্রো প্রয়াত

সিঁড়ি ভাঙতে স্বপ্ন ‘মেক ইন আমেরিকা’-ই

‘তোমাকে ভুল বুঝেছিলাম!’ ফিদেলকে লিখেছিলেন চে

সাম্রাজ্যবাদী হিংসার বিরুদ্ধে নীল আকাশের নাম

৬৩৪ বার খুন করার চেষ্টা হয়েছে ফিদেলকে?

আমেরিকার নাকের ডগায় ছোট্ট দ্বীপের স্পর্ধার নাম ফিদেল কাস্ত্রো

‘বিয়ার হাগ’ দিয়ে ইন্দিরাকে চমকে দিয়েছিলেন কাস্ত্রো

কাস্ত্রোর প্রয়াণে শোকাহত বাংলাদেশ

ফিদেল কাস্ত্রোর প্রয়াণে টুইট করলেন যাঁরা

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন