হঠাৎ এক সকালে সব খাঁ খাঁ, ছাদও নেই

সব হারিয়ে বেঁচে থাকার সেই যন্ত্রণা ভাগ করে নিতে এগিয়ে যান গার্ট্রুড শ্লেসিনজার কিপ। পেশায় মনঃসমীক্ষক (সাইকোঅ্যানালিস্ট) তিনি।

Advertisement

অন্বেষা দত্ত

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৯ মার্চ ২০১৮ ০৩:০৭
Share:

মনঃসমীক্ষক: গার্ট্রুড শ্লেসিনজার

তিন বছর আগের এক সকাল। বাস ভরে বিপন্ন মানুষ ঢুকছেন জার্মানির ছোট্ট শহর কাসল-এ। সিরিয়া, ইরাক, আফ্রিকা, আফগানিস্তান থেকে। কিছু দিন আগে দেশের চ্যান্সেলর আঙ্গেলা মের্কেল লক্ষ লক্ষ আশ্রয়হীন মুসলিম শরণার্থীর জন্য দরজা খুলে দিয়েছেন। খোলা পার্কে তাঁবু খাটিয়ে তাদের বসত।

Advertisement

সব হারিয়ে বেঁচে থাকার সেই যন্ত্রণা ভাগ করে নিতে এগিয়ে যান গার্ট্রুড শ্লেসিনজার কিপ। পেশায় মনঃসমীক্ষক (সাইকোঅ্যানালিস্ট) তিনি। ‘কমিটি অন উইমেন অ্যান্ড সাইকোঅ্যানালাইসিস’, পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়, ‘ইন্ডিয়ান সাইকোঅ্যানালিটিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন’ আয়োজিত আলোচনাচক্রে এসে সেই শরণার্থী মহিলাদের সঙ্কটের কথা জানান তিনি। যন্ত্রণাদীর্ণ মুখগুলোর ছায়া যেন তাঁর মুখেই।

কী মনে হয়েছিল ওদের মুখোমুখি হয়ে?

Advertisement

“আঘাত! অসম্ভব আঘাত। সিরিয়া থেকে আসা একটা পরিবারের কথা মনে পড়ছে। মহিলা চাকরি করতেন। দু’টো তিনটে বাচ্চা। সুস্থ পরিবার। যেমন হয়। হঠাৎ এক সকালে কিছু নেই! মাথার উপরের ছাদ উড়ে গিয়েছে। পড়শিরা পালাচ্ছে। কিছু বোঝার আগে উপচে পড়া নৌকায় ওঠা। বাচ্চাগুলোকে বাঁচানোর অদম্য আশায়।”

আরও পড়ুন: রক্ত, উকুনে ঢাকা শরীর দেখে পিছিয়ে যায় সেনা!

‘‘কোথায় আশ্রয় মিলবে সেটাও অজানা। পরিচয়হীনতা কুরে কুরে খাচ্ছে, অন্য একটা সংস্কৃতির ভিতরে হঠাৎ যেন কেউ জুতে দিয়েছে’’— বলছিলেন গার্ট্রুড। তাই প্রথমেই দরকার ছিল বিশ্বাস অর্জন। কিন্তু গার্ট্রুডের দেশ কি বিশ্বাস করে ওদের? না হলে শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য মের্কেলকে ভোটের সময় সমালোচিত হতে হয় কেন?

রঙিন: ঘরে ফেরার স্বপ্ন চোখে সিরীয় শিশুর আঁকা সেই ছবি।

গার্ট্রুড বলেন, “এমন একটা ভাবনা রয়েছে। পার্লামেন্টে অতি-দক্ষিণরা এসেছে। কিন্তু এটা সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাবনা নয়। এটা জার্মানি। ভাববেন না, এখানে ইহুদিদের সঙ্কট সকলে ভুলে গিয়েছেন। অনেক পরিবার আছে, যাদের দাদু-ঠাকুরদা-দিদা-ঠাকুরমা বা তার আগের প্রজন্ম এই যন্ত্রণা কী, জানেন। তাই শরণার্থী দেখলে সকলে রে রে করে উঠছেন, এমন নয়।”

এই নির্ভরতার আশ্বাস শরণার্থীদেরও দিয়েছেন তিনি। আফ্রিকা থেকে আসা বছর কুড়ি কী তারও কমবয়সি মেয়েকে। মা হওয়া কী, বোঝার আগেই বারবার ধর্ষিত হয়ে মাতৃত্বের ভার চেপে বসে যার মনে। দীর্ঘ আলাপচারিতায় একবারও ভুলে কারও নাম বলেন না গার্ট্রুড। কাজের নীতি তাঁকে আটকে রাখে সযত্নে। “নামে কী? ওঁদের কষ্ট এক। সিরিয়ার যে মহিলা, বাচ্চা, স্বামীর হাত ধরে নৌকায় উঠেছিলেন, বিদেশে পা রেখে স্বামী কোন শিবিরে ঠাঁই পেয়েছেন, তিনি জানেনও না। একের পর এক বিচ্ছেদ যন্ত্রণায় ওঁদের জীবনটা কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় ভাবুন!”

আর শরণার্থী শিশুরা? গার্ট্রুড জানালেন, শিশুরা সহজে মিশে যেতে পারে এটা যেমন ঠিক, তেমন নিজের আশ্রয় ছাড়ার যন্ত্রণাও তাদের থাকে। চলে আসার আগে একটা ছবি দেখালেন গার্ট্রুড। যে বাঙ্কারে পর পর শুতে হয়, তার মাঝের চিলতে জায়গায় সিরিয়ার এক শিশু ছবি এঁকেছে। যাত্রিবোঝাই নৌকার পাশে উদ্ধারকারী নৌকা, ঢেউ। যে দেশ সে ছেড়ে এসেছে, সেখানে ফুল-পাতা-বৃষ্টি। যুদ্ধ-বোমা-গুলি নয়, নিজের দেশ তার স্মৃতিতে এখনও সুন্দর!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন