মন খুললেই ভারত-বিরোধিতার ভাপ উড়ছে নেপালে

ভারতীয় কূটনীতিবিদদের একাংশ মনে করেন, নেপালে দীর্ঘদিনের অনুন্নয়ন, বেকারত্ব, নাজেহাল পরিকাঠামোর ফলে যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে তার মুখ সুকৌশলে এক দিকে ঘোরানোর প্রয়োজন ছিল।

Advertisement

অগ্নি রায়

কাঠমান্ডু শেষ আপডেট: ০৫ জুন ২০১৭ ১১:০০
Share:

কিছু শহর আছে যারা রাত গভীর হলেই, মনের কথা বলে! দিনের বেলা ব্যবসা-ধান্দা-পেশার খাতিরে মাপসই সংলাপ। রাজনৈতিক ভাবে সঠিক। রাত বাড়লে, ক্ষত বেরিয়ে পড়ে যে সব শহরের, তার মধ্যে অবশ্যই অগ্রগণ্য হিমালয়ের কোলের দেশের এই রাজধানী শহরটি।

Advertisement

‘‘রোটি-বেটি কা রিস্তা বলে আর কত দিন চালানো হবে? রক্সৌল থেকে নেপালে আসার ট্রাকগুলো যখন মাসের পর মাস বন্ধ করে রেখেছিল আপনার দেশ, তখন এখানকার অবস্থা কেউ এক বারও ভেবেছে? আমরা জানি তলে তলে এখানকার কিছু দালালের সঙ্গে ষড়যন্ত্র চলছে। নিজেদের স্বার্থে আবার বিপদে ফেলা হবে আমাদের,’’ ঘৃণায় মুখটা কি একটু বেঁকে গেল রূপক পাহাড়ির? আলো-আঁধারিতে ঠিক ঠাহর হয় না!

কাঠমান্ডুর দক্ষিণে একটি সরীসৃপের মত গলি থামেলে পৌঁছেছি। সরু, কিন্তু শেষ রাত পর্যন্ত উদ্দাম-উচ্ছল এই পাড়া। অজস্র নিশি বার, ট্রেকিং-কেন্দ্র, গয়নার দোকান, ক্যাসিনো। গোটা দিন ভারতীয় হাইকমিশন, নেপাল সরকারের পর্যটন মন্ত্রক, কিছু হোটেল কর্তার কাছে ভারত-নেপাল ‘সাংস্কৃতিক যোগাযোগ’, ‘ঐতিহাসিক বন্ধুত্বের’ বাঁধাধরা বুলি শুনে, রাতে হাজির হয়েছি ইয়েতি-র লোগো দেওয়া আধো-অন্ধকার একটি ক্যাসিনো কর্নারে। মুখোমুখি হয়েছি, এই প্রাচীন পাড়ায় বিশ বছর ম্যানেজারি করা রূপক পাহাড়ির। প্রথমেই এখানকার আতিথেয়তার রেওয়াজ মেনে হুক্কা এগিয়ে দিলেন পাহাড়ি। কিন্তু তার থেকে ভলকে ভলকে বেরিয়ে এল ভারত-বিরোধিতার ধোঁয়া!

Advertisement

আরও খবর
জীবনের শেষ ৬ মাস কেমন ছিলেন বন্দি সাদ্দাম

বারো বছর আগে রাজা জ্ঞানেন্দ্র যখন রাজকীয় অভ্যুত্থানের মাধ্যমে নিজের হাতে ক্ষমতা নিয়ে নিয়েছিলেন, তখন তা কভার করতে এসে দেখেছিলাম, এখানকার জীবন থমকে যায়নি। কিন্তু ২০১৫ সাল থেকে শুরু হওয়া ‘ভারতীয় মদতপ্রাপ্ত’ মদেশিয় অবরোধে নাকি দিন গুজরানই থেমে গিয়েছিল। দু’বছর আগের ঘটা ভূমিকম্পের দুঃস্বপ্ন ভুলে গিয়েছে এখানকার মানুষ। কিন্তু পোখরা লেকের বোট চালক থেকে শুরু করে পশুপতিনাথ মন্দির চত্বরের দর্শনার্থীদের মুখে ভারত সংক্রান্ত আলোচনার অনেকটাই জুড়ে রয়েছে সেই অবরোধের খতিয়ান। হ্যাঁ, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাওয়ার এত মাস পরেও।

কার্পেটে মোড়া বিস্তৃত সাউথ ব্লকের করিডর থেকে এই খেটে খাওয়া নেপালি মুখগুলির দূরত্ব নিশ্চয়ই অনেক। তবে, ভারতীয় কূটনীতিবিদদের একাংশ মনে করেন, নেপালে দীর্ঘদিনের অনুন্নয়ন, বেকারত্ব, নাজেহাল পরিকাঠামোর ফলে যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে তার মুখ সুকৌশলে এক দিকে ঘোরানোর প্রয়োজন ছিল। দু’বছর মদেশীয়দের বিক্ষোভ সেই জমে থাকা বারুদে দেশলাই কাঠি জ্বেলে দেয়। আর তখনই বড় আকারে খেলায় নামে চিন। নিত্যপ্রয়োজনীয় চাহিদা মেটাতে চিনের ওপর দৈনন্দিন নির্ভরশীলতার সেই শুরু।

নেপালে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর তৈরি করতে ২১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ দান থেকে শুরু করে পরিকাঠামো, জলবিদ্যুৎ, রেল, সড়ক নির্মানের মতো বিরাট চিনে প্রকল্পগুলি রমরম করে চলছে। কাঠমান্ডু থেকে পোখরা যাওয়ার ২০০ কিলোমিটার সড়কপথে চিনের প্ল্যাকার্ড দেওয়া ছাউনিতে চলছে উন্নয়ন যজ্ঞ। সদ্য চিন-নেপাল সামরিক মহড়াও হয়েছে এই প্রথম। ভারতীয় দূতাবাস সূত্রে বলা হচ্ছে, ‘‘চিন এখানে যা করছে তা নিছক মানবপ্রীতির খাতিরে— এমন কেউই বলবে না। এর পিছনে নির্দিষ্ট রাজনৈতিক, কৌশলগত উদ্দেশ্য রয়েছে।’’ ভারতের আরও শঙ্কার কারণ, কে পি ওলির নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্ট পার্টি অব নেপাল (ইউনিফাইড মার্কসিস্ট-লেনিনিস্ট)-কেন্দ্রীয় নির্বাচনে নেপাল কংগ্রেস এবং মাওবাদীদের কাছে হেরে গেলেও, চলতি স্থানীয় পঞ্চায়েত নির্বাচনে খুব ভাল ফল করছে। তাদের জনসভায় ভিড়ও হচ্ছে যথেষ্ট। সেই জনসভায় ভারত-বিরোধিতার স্বর প্রচ্ছন্ন নয়। এই ওলি’র নেতৃত্বাধীন সরকারের সময়ই চিনের সঙ্গে ব্যবসা ও ট্রানজিট বিষয়ক চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
আরও পড়ুন