পাড়ার সূর্য মোদকের সেই বিখ্যাত জলভরা তালশাঁসের কথা মনে হলেই মনটা আনচান করে! তাছাড়া মানিয়ে না নেওয়ার কিছু নেই। এমনকী ক্যান্টিনের খাওয়াদাওয়াও নাকি মেটায় বঙ্গসন্তানের রসনা।
ঐতিহ্যবাহী পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ে তখনও পৌঁছননি রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়। কিন্তু চলছে সাজো সাজো রব। একটু সকাল সকালই পৌঁছে গিয়েছিলেন চন্দননগরের অরবিন্দ সরণির বিশ্বজিৎ দাস। ফলিত গণিত নিয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য দেশ ছেড়ে চিনে এসেছেন বছর আড়াই আগে। “দেশে থাকতে আমারও ভীতি ছিল, এখানে এসেই বোধহয় সাপ-ব্যাঙ খেতে হবে! আরে মশাই এ সব বাজে কথা। আমাদের ক্যান্টিনে ডাল-ভাত-ভাজা মাছ-ডিম দিয়ে দিব্যি খাওয়া হয়ে যায়। বিশেষ করে বাঙালিদের তো কোনও সমস্যাই হয় না”, বলছেন বিশ্বজিৎবাবু।
প্রণববাবুর অনুষ্ঠান উপলক্ষে সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ-এর ভবন থেকে রবীন্দ্রনাথের আবক্ষ মূর্তি এনে সাজিয়ে রাখা হয়েছিল মূল গেটের সামনে। বিশ্বজিৎবাবুর মতো বাঙালি বা ভারতীয় ছাত্র গবেষকেরাই শুধু নন, চিনা ছাত্র-ছাত্রীদের ভিড় ও উদ্দীপনাও ছিল যথেষ্ট। হল ভরে গিয়েছিল সকালেই।
“বহু বছর পর কোনও ভারতীয় রাষ্ট্রপতি এলেন,” জানাচ্ছেন বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আসা বিশ্বজিৎ। তাঁর কথায়, “১৯২৪ সালে রবীন্দ্রনাথ এই বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছিলেন। ফিরে বিশ্বভারতীতে চিনা শিক্ষা শুরু করেন। আজও পিকিং বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বের সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির মধ্যে একটি।’’ তাঁর মতে, রাষ্ট্রপতির সফরের মাধ্যমে বিশ্বভারতী ও এখানকার মধ্যে যোগাযোগটা বাড়ানো গেলে সুবিধে হবে।
ভারতের রাষ্ট্রপতি আসছেন বলে কোনও মতে শাড়ি পরে এসেছিলেন জিং কে মু ওরফে হিমানি। ভারতকে ভালবেসে এখানে হিন্দি নিয়ে পড়াশোনা করছেন এই চিনা অষ্টাদশী। নামটাও বদলে করেছেন হিমানি। শুদ্ধ হিন্দিতে জানালেন যে রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে এখানে কথা বলার সুযোগ হয়তো হবে না। কিন্তু ভবিষ্যতে দিল্লিতে গিয়ে দেখা করবেনই। আর হ্যাঁ, আরও একজন ভারতীয় নাগরিককে ভালবাসা জানিয়ে দেওয়ার নাছোড় অনুরোধ করলেন এই চিনা যুবতী। “যদি শাহরুখ খানের সঙ্গে দেখা হয়, প্লিজ একটু বলে দেবেন ওকে খুব ভালবাসি! আসলে, আমার ভারতকে ভালবাসার এবং হিন্দি শেখার একটা বড় কারণ শাহরুখ!”
পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারতীয় হল অব ফেম-এ সাম্প্রতিকতম সংযোজন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। চিনা সরকারের উৎসাহ এবং তত্ত্বাবধানে সুনীলের ‘সেই সময়’ চিনা ভাষায় অনুবাদ হচ্ছে। আগামী বছরের গোড়াতেই কাজ শেষ হয়ে যাবে। গড়গড় করে বাংলায় এই খবরটি দিলেন সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ-এর অধিকর্তা ঝাং জিং। তিনিও বাংলা শিখেছেন রবীন্দ্রনাথকে ভালবেসে। বাংলায় ‘নৌকাডুবি’ পড়েছেন বহু বার। এখন পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ে ৭ জন বাংলা ভাষার ছাত্রছাত্রীকে পড়াচ্ছেন তিনি। জিং-এর কথায়, “ওরাই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সেই সময় অনুবাদে সাহায্য করছে। এটা একটা সরকারি প্রকল্প। এখনও চিন রবীন্দ্রনাথেই আটকে রয়েছে। তাই এই বিশেষ উদ্যোগ।”
তবে শিল্প সাহিত্য ফিল্মের কথা স্বতন্ত্র। ভারতকে চিন রাজনৈতিক ভাবে কতটা গুরুত্ব সত্যিই দেয়, তা নিয়ে কিন্তু যথেষ্ট সংশয় আছে ভারতীয় পড়ুয়াদের মনে। এঁদেরই মধ্যে একজন ভার্গবী বিশ্বনাথন। রাষ্ট্রপতিকে দেখবেন বলে এক দিকে উত্তেজিত। কিন্তু সেই সঙ্গে একটা প্রশ্ন সরাসরি ছুঁড়ে দিলেন চেন্নাই থেকে আসা ছাত্রী, “আপনারা তো সাংবাদিক। আমাদের দেশের কাগজে চিন নিয়ে প্রচুর লেখা হয়। কিন্তু আমরা এখানের কাগজে ভারত নিয়ে কোনও খবরই সে ভাবে পাই না কেন?’’ ভার্গবী জানাচ্ছেন, তাঁদের চিনা বন্ধুবান্ধবের মধ্যে ভারত সম্পর্কে ধারণা খুবই আবছা। একমাত্র বলিউড ছাড়া ভারত সম্পর্কে চিনা তরুণ তরুণীরা প্রায় কিছুই জানে না। রাষ্ট্রপতির সফরের জাঁকজমকের মাঝে এই মূল প্রশ্নটা ঝুলেই রইল।