গত বৃহস্পতিবার থেকে ফের উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ। ছবি: পিটিআই।
বাংলাদেশ নতুন করে উত্তপ্ত হওয়ার তিন দিন পরে রবিবার প্রথম বিবৃতি জারি করেছে ভারত সরকার। পড়শি দেশে সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণ নিয়ে ফের উদ্বিগ্ন দিল্লি। বিবৃতিতেও তার উল্লেখ রয়েছে। নয়াদিল্লির বিবৃতির কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই পাল্টা বিবৃতি প্রকাশ করে ঢাকাও। শেখ হাসিনাকে কেন্দ্র করে দিল্লি এবং ঢাকার মধ্যে কূটনৈতিক টানাপড়েন চলছিলই। এ বার বিবৃতি এবং পাল্টা বিবৃতি তা আরও বাড়িয়ে দিল।
গত বৃহস্পতিবার রাত থেকে নতুন করে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ। ওই রাতেই মৃত্যু হয় বাংলাদেশের ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক ওসমান হাদির। হাসিনা বিরোধী বলে পরিচিত বাংলাদেশের এই তরুণ নেতাকে অতীতে ভারত বিরোধী বিভিন্ন মন্তব্যও করতে দেখা গিয়েছিল। হাদির মৃত্যুর পর থেকে দৃশ্যত অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি তৈরি হয় বাংলাদেশে। তাণ্ডব চলে সংবাদপত্রের দফতরে। হয় ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ। সাংবাদিক হত্যার অভিযোগ ওঠে। এই অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতির মাঝেই ময়মনসিংহে পিটিয়ে হত্যা করা হয় দীপুচন্দ্র দাসকে। অভিযোগ, খুনের পরে তাঁর দেহ পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ওই ঘটনাকে কেন্দ্র করেই কূটনৈতিক টানাপড়েন আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। দীপুর হত্যাকাণ্ডে বিচারের দাবি তুলে বিবৃতি দিয়েছে ভারতীয় বিদেশ মন্ত্রক।
দ্বিপাক্ষিক স্তরে চাপানউতর শুরু হয়েছিল হাদির মৃত্যুর কয়েক দিন আগে থেকেই। ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাই কমিশনার প্রণয় বর্মাকে তলব করেছিল বাংলাদেশের বিদেশ মন্ত্রক। বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কর্মকাণ্ড নিয়ে উদ্বেগপ্রকাশ করে বার্তা দেওয়া হয়েছিল ভারতকে। তার কয়েক দিন পরেই দিল্লিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাই কমিশনার এম রিয়াজ হামিদুল্লাকে তলব করল ভারতের বিদেশ মন্ত্রক। সম্প্রতি এক বক্তৃতায় বাংলাদেশের তরুণ নেতা হাসনাত আবদুল্লা ‘সেভেন সিস্টার্স’কে ভারতের মানচিত্র থেকে আলাদা করে দেওয়ার আহ্বান করেন। শুধু তা-ই নয়, উত্তর-পূর্ব ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আশ্রয় দেবে বাংলাদেশ, এমনও মন্তব্য করেন তিনি। হাসনাতের ওই বক্তৃতার প্রেক্ষিতেই তলব করা হয়েছিল বাংলাদেশের হাই কমিশনারকে। বস্তুত, কূটনৈতিক চাপানউতরের একটি প্রেক্ষাপট তখন থেকেই তৈরি হচ্ছিল। রবিবার দু’দেশের তরফে বিবৃতি এবং পাল্টা বিবৃতিতে তা আরও স্পষ্ট হল।
দীপুহত্যায় বিচারের দাবি দিল্লির
বৃহস্পতিবার থেকে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বাংলাদেশে, তা নিয়ে রবিবারই প্রথম মুখ খোলে ভারত। ভারতীয় বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল একটি বিবৃতিতে বলেছেন, ‘‘বাংলাদেশের পরিস্থিতির দিকে নিবিড় ভাবে নজর রেখেছে ভারত। সে দেশের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আমাদের আধিকারিকেরা যোগাযোগ রাখছেন। সংখ্যালঘুদের উপর হামলা নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন— তা তাঁদের জানানো হয়েছে। দীপুর নৃশংস হত্যাকাণ্ডে অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। ভারত সেই আবেদন জানিয়েছে।’’
ময়মনসিংহের হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে নয়াদিল্লিতে অবস্থিত বাংলাদেশি দূতাবাসের সামনে শনিবার এক দল যুবক বিক্ষোভ দেখিয়েছিলেন। কয়েকটি বাংলাদেশি সংবাদমাধ্যমে তা নিয়ে ভুয়ো এবং অতিরঞ্জিত খবর প্রচার করা হচ্ছে বলে অভিযোগ। এই সংক্রান্ত প্রশ্নের উত্তরে রণধীর বলেছেন, ‘‘বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমের একাংশের মধ্যে আমরা ভুয়ো প্রচার দেখতে পাচ্ছি। সত্যিটা হল, শনিবার নয়াদিল্লির বাংলাদেশি দূতাবাসের সামনে ২০-২৫ জন যুবক জড়ো হয়েছিলেন। তাঁরা ময়মনসিংহে দীপুর হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান এবং স্লোগান দেন। বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের সুরক্ষার দাবি জানান। দূতাবাসে জোর করে প্রবেশের কোনও চেষ্টা করা হয়নি। পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে বিক্ষোভকারীদের কিছু ক্ষণের মধ্যেই সরিয়ে দেয়। এর ফুটেজ প্রকাশ্যেই রয়েছে।’’ ভারতের মাটিতে অবস্থিত যে কোনও বিদেশি প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে নয়াদিল্লি বদ্ধপরিকর, জানিয়েছেন রণধীর।
পাল্টা বিবৃতি বাংলাদেশের
ভারতীয় বিদেশ মন্ত্রকের ওই বিবৃতির কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই পাল্টা বিবৃতি প্রকাশ করে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের বিদেশ মন্ত্রক। ময়মনসিংহের ঘটনা নিয়ে ভারতের বিবৃতির আপত্তি জানিয়েছে তারা। মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার ওই বিবৃতিতে দাবি করেছে, ময়মনসিংহের ঘটনা একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। ভারতের কর্তৃপক্ষ বিষয়টিকে সংখ্যালঘুদের উপর হামলা বলে দেখাচ্ছেন বলে দাবি করেছে তারা। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের বিদেশ মন্ত্রকের দাবি, বাংলাদেশে একজন নাগরিকের নৃশংস হত্যাকাণ্ডকে সংখ্যালঘু নিরাপত্তার সঙ্গে যুক্ত করার কোনো যৌক্তিকতা নেই। ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকারের বিদেশ মন্ত্রক বিবৃতিতে দাবি করেছে, ময়মনসিংহের ঘটনায় তারা দ্রুত পদক্ষেপ করেছে। অভিযুক্তদের গ্রেফতারও করেছে। দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি যথেষ্ট ভাল বলে দাবি ঢাকার।
দিল্লিতে বাংলাদেশে দূতাবাসের সামনে বিক্ষোভের ঘটনাকেও ভারত সরকার ‘সরলীকরণ’ করছে বলে দাবি বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের। ২০-২৫ জনের একটি দল কী ভাবে একটি সংবেদনশীল এলাকায় প্রবেশ করতে পারল, তা নিয়েও প্রশ্ন বাংলাদেশের। ঢাকার দাবি, স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে অনুমতি ছাড়া সেখানে পৌঁছোতে পারার কথা নয়। ভারতের বিবৃতির পর পরই ঢাকার এই পাল্টা বার্তা দ্বিপাক্ষিক কূটনৈতিক চাপানউতরকে আরও বৃদ্ধি করল বলে মনে করা হচ্ছে।
চট্টগ্রামে বন্ধ ভিসা-কেন্দ্র
রবিবার থেকে অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ করা হয়েছে চট্টগ্রামের ভারতের ভিসা আবেদন কেন্দ্র (আইভ্যাক বা ইন্ডিয়ান ভিসা অ্যাপ্লিকেশন সেন্টার)। রবিবার আইভ্যাকের ওয়েবসাইটে জানানো হয়েছে, চট্টগ্রামে ভারতীয় অ্যাসিস্ট্যান্ট হাইকমিশনে (এএইচসিআই) সম্প্রতি যে নিরাপত্তা সংক্রান্ত ঘটনা ঘটেছে, তার জেরেই এই সিদ্ধান্ত। পরবর্তী বিজ্ঞপ্তি জারি না করা পর্যন্ত এই পরিষেবা বন্ধ থাকবে। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করার পরে সেইমতো ভিসা আবেদন কেন্দ্র আবার খোলার কথা ঘোষণা করা হবে।
বস্তুত, গত বৃহস্পতিবার কয়েক জন চট্টগ্রামের খুলসীতে ভারতীয় উপহাইকমিশনের সমানে অবস্থান বিক্ষোভ করেন। অভিযোগ, সেখানে বসেই আওয়ামী লীগ এবং ভারত-বিরোধী স্লোগানও দেওয়া হয়। ভারতীয় উপ-হাইকমিশনের দফতর লক্ষ্য করে ইট ছোড়ার অভিযোগ উঠেছে। পুলিশ এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে। বিক্ষোভকারীদের হটাতে লাঠি চালায় এবং কাঁদানে গ্যাস ছোড়ে পুলিশ। তারপরেই রবিবার অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয় চট্টগ্রামের ভিসা-কেন্দ্র।
নিরাপত্তা বৃদ্ধি সিলেটে ভারতীয় উপহাইকমিশনে
দেশজোড়া অশান্তি ও বিক্ষোভের মাঝে বাংলাদেশের সিলেটে অবস্থিত ভারতীয় উপহাইকমিশন এবং ভিসা আবেদন কেন্দ্রের নিরাপত্তা আরও বৃদ্ধি করেছে মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার। শুক্রবার থেকেই বাংলাদেশের সিলেটে ভারতের সহকারী হাই কমিশনের দফতর এবং ভিসা আবেদন কেন্দ্রের নিরাপত্তা আরও জোরদার করা হয়েছে। সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার সাইফুল ইসলামকে উদ্ধৃত করে শনিবার বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম ‘ঢাকা ট্রিবিউন’ জানিয়েছে, ‘‘কোনও তৃতীয় পক্ষ যাতে পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে অশান্তি ছড়াতে না পারে, তা নিশ্চিত করার জন্যই বাড়তি নিরাপত্তা দেওয়া হয়েছে ওই অঞ্চলে।’’
দীপু হত্যাকাণ্ডের গ্রেফতার আরও দুই
দীপু হত্যার তদন্তে নেমে আরও দু’জনকে গ্রেফতার করেছে বাংলাদেশের পুলিশ। শনিবার রাতেই আশিকুর রহমান এবং কাইয়ুম নামে ওই দুই অভিযুক্তকে গ্রেফতার করা হয়েছে। দু’জনেরই বাড়ি ভালুকার জামিরদিয়া ডুবালিয়াপাড়া এলাকায়। ঘটনার বিভিন্ন ভিডিয়ো দেখে শনাক্ত করে ওই দুই যুবককে গ্রেফতার করা হয়েছে। সব মিলিয়ে ওই ঘটনায় ধৃতের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ১২। ওই সময় আরও যাঁরা ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন, তাঁদের খোঁজেও তল্লাশি চলছে। ময়মনসিংহের ঘটনায় আগেই ১০ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ এবং র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। ধৃতেরা হলেন মহম্মদ লিমন সরকার, মহম্মদ তারেক হোসেন, মহম্মদ মানিক মিয়া, এরশাদ আলি, নিজুম উদ্দীন, আলমগির হোসেন, মহম্মদ মিরাজ হোসেন আকন, মহম্মদ আজমল হাসান সগীর, শাহিন মিয়া এবং মহম্মদ নাজমুল।
তাণ্ডব নিয়ে বিবৃতি ছায়ানটের
বৃহস্পতিবার রাতে বাংলাদেশ জুড়ে যে তাণ্ডব শুরু হয়েছিল, তার রেশ আছড়ে পড়ে ঢাকার ঐতিহ্যবাহী ছায়ানট সাংস্কৃতিক ভবনেও। চলে ভাঙচুর, তাণ্ডব। ওই ঘটনায় রবিবার একটি বিবৃতি প্রকাশ করেছেন ছায়ানট কর্তৃপক্ষ। তাঁরা জানিয়েছেন, গত বৃহস্পতিবার ছ’তলা ভবনের প্রায় প্রতিটি কক্ষই বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। অজ্ঞাতপরিচয় একটি দল ভবনে লুটপাট চালিয়েছে এবং অগ্নিসংযোগ করেছে। পরে পুলিশ এবং সেনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে বলে জানান ছায়ানট কর্তৃপক্ষ। তাঁরা আরও জানিয়েছেন, সকল প্রতিকূলতার মাঝেও বাঙালির আবহমান সংস্কৃতি চর্চা এবং সঙ্গীত সাধনা ও প্রসারে অবিচল থাকবে ছায়ানট। ওই তাণ্ডবের ঘটনায় ছায়ানটের ম্যানেজার দুলাল ঘোষ শনিবার ৩০০ থেকে ৩৫০ জন অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা রুজু করেছেন।