এক দিকে ভারতের মাটিতে পাক বায়ুসেনার হামলা। পাক সেনার হাতে ভারতীয় মিগের পাইলটের বন্দি হওয়া। অন্য দিকে পাক প্রধানমন্ত্রী এবং সেনার তরফে ভারতকে নতুন করে শান্তি ও আলোচনার বার্তা। দ্বিপাক্ষিক সামরিক সক্রিয়তার আবহে এমন নরমে-গরমে কৌশল নিয়ে এগোচ্ছেন ইমরান খান।
পাক পরমাণু অস্ত্রভাণ্ডারের দায়িত্বপ্রাপ্ত ‘ন্যাশনাল কম্যান্ড অথরিটি’-র সঙ্গে বৈঠকের পরে আজ টিভিতে মিনিট পাঁচেকের বক্তৃতা দেন ইমরান। তাতে ভারত সরকারের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘‘আমাদের কি এই মুহূর্তে ভাবা উচিত নয় যে, এখান থেকে ব্যাপারটা বাড়তে থাকলে তা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? (নিয়ন্ত্রণ) না আমার হাতে থাকবে, না নরেন্দ্র
মোদীর হাতে।’’
ক্ষমতায় আসার আগে থেকেই ‘সেনার হাতের পুতুল’ বলে কটাক্ষ শুনতে হয়েছে ইমরানকে। অনেকের মতে, ইমরান কার্যত বুঝিয়েই দিয়েছেন, সেনা পুরোদস্তুর মাঠে নেমে পড়লে তাঁর আর কিছু করার থাকবে না। তাই সতর্কতার সুরেই তিনি ভারতকে বলেছেন, ‘‘দুনিয়ার সমস্ত যুদ্ধেই হিসেবের গন্ডগোল হয়েছে। কেউ ভাবেনি, যে যুদ্ধ শুরু করছি, সেটা কোথায় গিয়ে শেষ হবে। ভারত সরকারকে বলছি, আপনাদের এবং আমাদের কাছে যে সব অস্ত্র আছে, তাতে এই ধরনের হিসেবের গন্ডগোল করাটা কি ঠিক হবে? তাই আবার আপনাদের আমন্ত্রণ জানাচ্ছি, কথা বলে সমস্যা মেটান। যে কোনও ধরনের আলোচনায় আমরা তৈরি। শুভবুদ্ধির উদয় হোক।’’
ইমরানের কথা টেনেই পাক সেনার মুখপাত্র আসিফ গফুর সাংবাদিক বৈঠকে বলেন, ‘‘আমরা বরাবর শান্তির বার্তা দিয়েছি। আলোচনাই শান্তির পথ। ভারতের বোঝা উচিত, যুদ্ধ আসলে নীতির ব্যর্থতা। যুদ্ধ শুরু করা সহজ, কোথায় শেষ হবে, কেউ
জানে না।’’
প্রশ্ন হল, শান্তি চাইলে পাক বায়ুসেনা আজ পাল্টা অভিযানের চেষ্টা চালাল কেন?
ইমরানের যুক্তি, ‘‘কোনও সার্বভৌম রাষ্ট্রই নিজের মাটিতে অন্য দেশের খবরদারি বরদাস্ত করে না। আমরা শুধু এটাই ভারতকে বলতে চাইছিলাম যে, আপনারা আমাদের মাটিতে ঢুকতে পারলে আমরাও আপনাদের দেশে ঢুকতে পারি।’’ পাক প্রধানমন্ত্রীর দাবি, গত কাল ভারতীয় বায়ুসেনার অভিযানের পরেই তাঁরা তড়িঘড়ি পাল্টা ব্যবস্থা নিতে চাননি।
কারণ (ভারতের অভিযানে) পাকিস্তানে কতটা ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তা জানার দরকার ছিল। পাকিস্তানে কোনও জান-মালের ক্ষতি যখন হয়নি, তখন পাক হামলায় ভারতে কারও প্রাণ গেলে তা ‘দায়িত্বজ্ঞানহীন’ কাজ হত বলে ইমরানের মত। তাঁর কথায়, ‘‘এই কারণেই আমাদের পরিকল্পনা ছিল, যে কোনও অসামরিক ক্ষয়ক্ষতি বা মৃত্যু এড়াতে হবে।’’
সামরিক উত্তেজনার আবহের সঙ্গে ভারতের নির্বাচনকেও অবশ্য জড়িয়েছেন ইমরান। পুলওয়ামা হামলার পরে নয়াদিল্লি সুর চড়ানোয় তিনি বলেছিলেন, প্রয়োজনে পাকিস্তান প্রত্যাঘাতে তৈরি। আজ পাক প্রধানমন্ত্রীর দাবি, ভারতে ভোট আসন্ন বলেই তাঁর মনে হয়েছিল, কোনও না কোনও পদক্ষেপ করতে পারে প্রতিবেশী দেশ। তাই ওই কথা বলেছিলেন। কিন্তু পুলওয়ামা হামলার পরে তদন্তে যাবতীয় সাহায্যের আশ্বাসও দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, কোনও পাকিস্তানির জড়িত থাকার প্রমাণ মিললে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ইমরানের মতে, বর্তমান পরিস্থিতিতে আগামীর রাস্তাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এখানেই বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দেওয়া প্রয়োজন। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে ভিয়েতনাম যুদ্ধ, আফগানিস্তানে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আমেরিকার যুদ্ধ— একের পর এক উদাহরণ দিয়ে তিনি বোঝাতে চেয়েছেন, হিসেবের গন্ডগোল বরাবরই হয়ে এসেছে যুদ্ধে। শুরুর সময়ে কেউ বলতে পারে না, কবে তা শেষ হবে। আর সেনা মুখপাত্র গফুর বলেছেন, ‘‘আজকের ঘটনার জন্য কোনও জয় ঘোষণা করতে চাই না। যুদ্ধে মনুষ্যত্বের পরাজয় হয়। সংবাদমাধ্যমকে অনুরোধ, প্রতিবেদনে শান্তির কথা বলুন।’’
এতটা নরম সুর অবশ্য শোনা যায়নি পাক বিদেশমন্ত্রী শাহ মেহমুদ কুরেশির গলায়। আগামী ১ ও ২ মার্চ আবু ধাবিতে মুসলিম দেশগুলির গোষ্ঠী (ওআইসি)-র বিদেশমন্ত্রীদের সম্মেলনে অতিথি হিসেবে যোগ দেওয়ার কথা ভারতের বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের। কুরেশি বলেছেন, ‘‘ওআইসি-র এক প্রতিষ্ঠাতা সদস্য দেশকে আক্রমণ করেছে ভারত। সুষমা ওআইসি সম্মেলনে যোগ
দিলে আমি সেখানে যাব না।’’ গত কালই যদিও বিবৃতি দিয়ে ভারতীয় বায়ুসেনার অভিযানের সমালোচনা করেছিল ওআইসি।