এরদোগানের ইসলামি ঝোঁকই কি বিদ্রোহ ডেকে আনল?

তুরস্কে সেনা অভ্যুত্থান ব্যর্থ। নিহতের সংখ্যা প্রায় দু’শো ছুঁয়েছে। যার মধ্যে সাধারণ নাগরিকও রয়েছেন। অভ্যুত্থানে জড়িত সন্দেহে আড়াই হাজারেরও বেশি সেনাকে আটকে করা হয়েছে। আপাতত প্রেসিডেন্ট এরদোগান সুরক্ষিত।

Advertisement

রত্নাঙ্ক ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ১৬ জুলাই ২০১৬ ১৯:৩১
Share:

তুরস্কে সেনা অভ্যুত্থান ব্যর্থ। নিহতের সংখ্যা প্রায় দু’শো ছুঁয়েছে। যার মধ্যে সাধারণ নাগরিকও রয়েছেন। অভ্যুত্থানে জড়িত সন্দেহে আড়াই হাজারেরও বেশি সেনাকে আটকে করা হয়েছে। আপাতত প্রেসিডেন্ট এরদোগান সুরক্ষিত। কিন্তু প্রায় এক দশক ধরে দোর্দণ্ড প্রতাপে শাসন চালানোর পরে এরদোগানের কর্তৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠল। এবং উঠল বেশ জোরালো ভাবেই।

Advertisement

১৯২৩-এ আধুনিক তুরস্কের প্রতিষ্ঠার পর থেকে ধর্মনিরপেক্ষতাকে এই রাষ্ট্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য বলে ধরে নেওয়া হয়েছিল। তুরস্কের সেনা এই ধর্মনিরপেক্ষতার অন্যতম কাণ্ডারী। সেনা অভ্যুত্থান তুরস্কে নতুন নয়। ১৯৬০, ’৭১, ’৮০ এবং ’৯৭ সালে তুরস্কের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় সেনা হস্তক্ষেপ করেছে। রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র বজায় রাখা এই হস্তক্ষেপগুলির অন্যতম কারণ হিসেবে দর্শানো হয়েছিল। এ বারও সাময়িক ভাবে ক্ষমতা দখলের পরে, বিদ্রোহী সেনারা গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা বজার রাখার জন্যই এই অভ্যুত্থান বলে জানিয়েছিল। অভ্যুত্থান ব্যর্থ হলেও গণতান্ত্রিক কাঠামো ও ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে বিদ্রোহী সেনাদের তোলা প্রশ্নটি কিন্তু তুরস্কের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
সাধারণ পরিবার থেকে উঠে আসা এরদোগানের সঙ্গে সাত এবং আটের দশকে ইসলামিক মতাদর্শের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। এরদোয়ানের দল ‘জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি’ ইসলামিক মতাদর্শের ভিত্তিতেই তৈরি, যা তুরস্কের ধর্মনিরপেক্ষ কাঠামোর সঙ্গে কিছুটা বেখাপ্পা। তা সত্বেও ক্ষমতায় আসার পরে তুরস্কের সমাজের বড় অংশের সমর্থন পেয়েছিলেন এরদোগান। বিশেষ করে তুরস্কের রাজনীতি থেকে সেনাকে সরিয়ে দিয়ে ব্যারাকে ফেরত পাঠানোর নীতি সমাজের বড় অংশের সমর্থন পেয়েছিল।

ইস্তানবুলের রাস্তায় তখন নেমে পড়েছে সাধারণ মানুষ। ছবি: এএফপি।

Advertisement

কিন্তু ক্ষমতা যতই এরদোগানের করায়ত্ত হয়েছে, ততই সেই সমর্থনের গ্রাফ নীচের দিকে নামতে শুরু করেছে। ঘনিষ্ঠ পরামর্শদাতারা দূরে সরে গিয়েছেন। এরদোগানের নানা সিদ্ধান্ত নিয়ে সমালোচনা শুরু হয়েছে। সেই সমালোচনা থেকে শিক্ষা না নিয়ে বরং সমালোচকদের মুখ বন্ধ করতেই ব্যস্ত থেকেছেন এরদোগান। সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব করা হয়েছে, সাংবাদিকদের গ্রেফতার করা হয়েছে, আমলাদের মধ্যে থেকে অপচ্ছন্দের লোকেদের সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ পদে পরিচিত এমনকী পরিবারের সদস্যদের বসানো হয়েছে। পারিবারিক অবস্থা ফুলে ফেঁপে উঠেছে। দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। আঙ্কারার সাধারণ আবাসন থেকে উঠে আসা এরদোগান প্রেসিডেন্টের জন্য বিশাল প্রাসাদ বানিয়েছেন। ২০১৩ সালে এরদোগানের ঘনিষ্ঠদের বিরুদ্ধে ওঠা দুর্নীতির অভিযোগের তদন্ত শুরু হয়েছিল। তখনই এরদোগানের এক সময়ের ঘনিষ্ঠ ধর্মপ্রচারক ফেথুল্লা গুলেন সঙ্গে মতবিরোধ শুরু। দেশ থেকে বিতাড়িত হয়ে গুলেন এখন আমেরিকার পেনসিলভেনিয়ায় থাকেন। এ দিন সেনা অভ্যুত্থানের পরে এই গুলেনকেই দায়ী করেছেন এরদোগান। কিছু দিন আগেই গুলেনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার অভিযোগে বেশ কয়েক জন বিচারক, আমলা এবং পুলিশ অফিসারকে বহিষ্কার করা হয়।

আরও পড়ুন: শুটিং করতে এসে সেনা বিদ্রোহের মধ্যে পড়ব, কখনও ভাবিনি

এ কথা ঠিক যে তুরস্কের নাগরিকদের একটা বড় অংশের সমর্থন এখনও এরদোগানের পক্ষে রয়েছে। সেই সমর্থনের জোরেই এ দিনের সেনা অভ্যুস্থানকে ঠেকানো গিয়েছে। কিন্তু এই সমর্থন বজায় রাখতে এরদোগান তুরস্ককে ইসলামিক আদর্শের দিকে ঝুঁকিয়েছেন বলে অভিযোগ। এরদোগান জাতীয় জীবনে ইসলামের প্রসার বাড়িয়েছেন। ২০১৫ সালে নির্বাচনী প্রচারের সময়ে কোরান হাতে এরদোগানকে প্রচার করতেও দেখা গিয়েছে। এ দিন অভ্যুত্থানের খবর আসার পরে ইস্তানবুল ও আঙ্কারার বিভিন্ন মসজিদ থেকে জনগণকে রাস্তায় নামার ডাক দেওয়া হয়। কিন্তু তুরস্কের নাগরিক সমাজে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে, তুরস্ক কি তার ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শ থেকে সরে আসছে। এই ক্ষেত্রে সিরিয়ার লড়াই নতুন মাত্রা জুগিয়েছে।
সিরিয়ায় প্রথমে বাসার আল-আসাদ বিরোধী শক্তিকে সমর্থন করে তুরস্ক। ফলে তুরস্ক জেহাদিদের প্রিয় গন্তব্য হয়ে ওঠে। তুরস্ক জুড়ে জেহাদি সেল তৈরি হয়। আইএস যোগ দেওয়ার প্রধান রাস্তা তুরস্কই হয়ে গিয়েছে। কিন্তু ইসলামিক স্টেট যত শক্তিশালী হতে থাকে তত তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য এরদোগানের উপরে বাকি দেশগুলির চাপ বাড়তে থাকে। প্রবল চাপে নিজের বিমানঘাঁটি আমেরিকাকে ব্যবহারের অনুমতি দেয় তুরস্ক। কিন্তু নিজের সেনা ব্যবহার থেকে বিরত থাকে। তুরস্ক-সিরিয়ার সীমানায় কোবানে শহরে যখন আইএস-কে ঠেকাতে কুর্দরা জোর লড়াই করছে তখন সীমান্তে চুপচাপ তুরস্কের সেনা দাঁড়িয়ে ছিল। পরে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে পড়ে ইরাক থেকে কুর্দ যোদ্ধাদের কোবানেতে যাওয়ার অনুমতি দেয় তুরস্ক।

আরও পড়ুন:রাতের অন্ধকারে তুরস্কে সেনা অভ্যুত্থানের চেষ্টা,রক্তাক্ত সংঘাতে হত ১৯৪

অভিযোগ ছিল, চোরা পথে তুরস্কে তেল বেচে বিপুল অর্থ উপার্জন করছে আইএস। কিন্তু সেই ব্যবসা বন্ধ করতে এরদোগানের সরকার কোনও ব্যবস্থা নিচ্ছে না। আকাশসীমা লঙ্ঘনের অভিযোগে রুশ যুদ্ধবিমানকে গুলি করে নামানোর পর রাশিয়ার তরফ থেকেও এই অভিযোগ তোলা হয়েছিল। রাশিয়ার যুদ্ধবিমান তুরস্কে তেল চোরাচালানের পথে নজরদারি চালানোর জন্যই এই আক্রমণ বলে অভিযোগ তোলা হয়েছিল। এই চোরাই তেলের ব্যবসায় এরদোগানের ঘনিষ্ঠরা লাভবান হচ্ছেন বলে সরাসরি অভিযোগ করে রাশিয়া। রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হয়। এর আগেই মিশরের সঙ্গেও সম্পর্কের অবনতি হয়েছে। ইসলামিক ব্রাদারহুডের নেতা মরসিকে সরিয়ে সেনাপ্রধান আল-সিসির প্রেসিডেন্ট হওয়াকে নিন্দা করেছিল তুরস্ক।
‌এই টালমাটাল অবস্থায় তুরস্কের দক্ষিণ-পশ্চিমে কুর্দ বিছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে আবার যুদ্ধ শুরু করেন এরদোয়ান। কুর্দদের ঘাঁটিতে বিমানহানা শুরু হয়। পুরনো জাতিবিদ্বেষ চাগিয়ে ওঠে। কুর্দ বিচ্ছিন্নতাবাদীরা আঙ্কারা, ইস্তানবুলে পাল্টা হামলা চালায়। অন্য দিকে আইএসের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ায় তারাও পাল্টা হামলা করে। ক’দিন আগেই ইস্তানবুল বিমানবন্দরে আইএস হামলায় ৪২ জনের প্রাণ যায়। এই অবস্থায় আবার সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাসার আল-আসাদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহী হয়েছেন এরদোগান। পাশাপাশি রাশিয়া ও মিশরের দিকেও বন্ধুত্বের হাত বাড়াবেন বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সব মিলিয়ে এরদোগানের নীতিই তুরস্কের সমাজে অস্থিরতা তৈরি করেছিল। তারই বহিঃপ্রকাশ আজকের সেনা অভ্যুত্থান।
শোনা যাচ্ছে বিদ্রোহী সেনাদের শাস্তি দেওয়ার জন্য মৃত্যুদণ্ডের শাস্তি আবার ফিরিয়া আনতে চাইছে এরদোগানের সরকার। কিন্তু এ ভাবে এরদোগান ক্ষমতা ধরে রাখতে পারবেন কি না তা নিয়ে সংশয় রয়েই যাচ্ছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন