ঘর-গেরস্থালির কিছু যদি মেলে...। চলছে খোঁজ। কাঠমান্ডুর কাছে ভক্তপুরে। ছবি: এএফপি।
দুঃস্বপ্নের ঘুম ভেঙে ধীরে ধীরে জেগে উঠছে কাঠমান্ডু।
বন্ধ দোকানের ঝাঁপ খুলছে এক এক করে। খুলছে এটিএম-ও। বিদেশি মুদ্রা ভাঙানোর দোকানগুলোতেও ভিড়়। ভূমিকম্পের ভয়কে পিছনে ফেলে গুটি গুটি পায়ে রাস্তায় বেরোতে শুরু করেছেন শহরবাসীও। আজ প্রায় পাঁচ দিন বাদে বাজার খুলেছে কাঠমান্ডুতে। জোগান স্বাভাবিক না হওয়ায় দাম উর্ধ্বমুখী। তবে আগামী দু’তিন দিনের মধ্যে গ্রাম থেকে নতুন জোগান না এলে জিনিসের দাম আকাশ ছুঁতে চলেছে বলে মনে করছে কাঠমান্ডু ব্যবসায়ী সংগঠন।
এমনিতে এখন অবশ্য শহর অনেকটাই স্বাভাবিক। মিলছে বিদ্যুৎ বা বিমান পরিষেবা। দরবার স্কোয়ার থেকে ধরহরা টাওয়ার— সর্বত্রই ধ্বংসস্তূপ সরানোর কাজ চলছে। পুরোদমে না হলেও শহরের মধ্যে শুরু হয়েছে বাস পরিষেবা। চলছে ট্যাক্সি। কাঠমান্ডুর কুখ্যাত যানজট এখনও ফিরে না এলেও গত কয়েক দিনের শূন্য রাস্তা আজ অনেকাংশেই সরগরম। পুরকর্মীরা আজ থেকে কাজে যোগ দেওয়ায় আবর্জনার স্তূপও সরছে রাস্তার দু’পাশ থেকে।
কিন্তু তবু কোথাও যেন একটা চাপা ভয়। আতঙ্ক কুরে কুরে খাচ্ছে শহরবাসীকে। শনি-রবিবারের কম্পনের রেশ যে কোন গোপন অন্তঃস্থলে ঘর বেঁধেছে, তার প্রমাণ মিলল আজ দুপুরেই। খেতে বসেছিলাম একটি গুমটি রেস্তোরাঁয়। হঠাৎ ছাদে অস্বাভাবিক আওয়াজ। খাওয়া মাথায়। দুদ্দাড় করে বেরিয়ে এলেন সবাই।
মায় হোটেল মালিক। চোখে-মুখে ভয়। কী হল, কী হল ভাব। পরে দেখা গেল বাঁদরের দঙ্গল খাবারের খোঁজে বেরিয়েছে! কিন্তু ওই ছোট্ট ঘটনাই বুঝিয়ে দিল, এখনও কী ভাবে কাঁটা হয়ে আছেন শহরবাসী।
এই আতঙ্কের সঙ্গে হয়তো আরও কিছু দিন ঘর করতে হবে নেপালবাসীকে।
শহর স্বাভাবিক হতে শুরু করলেও রাজধানী থেকে মানুষের চলে যাওয়ার কোনও খামতি নেই। ঘণ্টায়-ঘণ্টায় বাস ভর্তি করে লোক পালাচ্ছে। বাস চলাচল শুরু হতেই দেশের বাড়ি ফিরছেন মীরবাহাদুরের মতো অনেকে। পশুপতিনাথ মন্দিরের সামনে বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে কথা হচ্ছিল জনকপুরের বাসিন্দা মীরের সঙ্গে। সরকারি চাকরির সুবাদে পরিবার নিয়ে রাজধানী থাকেন তিনি। ভূমিকম্পে বাড়ির সকলে ঠিক থাকলেও গ্রামের বাড়িতে মা-বাবা ও ভাইয়ের পরিবার কেমন আছে, তা এখনও জেনে উঠতে পারেননি। তাই বাড়ির পথে ছুটছেন।
ভূমিকম্পের সুযোগে টিকিট নিয়েও চলছে কালোবাজারি। রাত জেগে লাইন দিয়ে ন্যায্য দামে টিকিট পাননি মীর। ক্ষোভ উগরে বললেন, ‘‘সরকার বলছে বিনামূল্যে টিকিট দিচ্ছে। কোথায় কী! দালালের কথা শুনলে এক দিন আগেই পৌঁছে যেতাম।’’ আসলে কাঠমান্ডুর ৩০ লক্ষ জনসংখ্যার মধ্যে ইতিমধ্যেই রাজধানী ছেড়েছেন প্রায় লক্ষাধিক মানুষ। চলে যাওয়ার অপেক্ষায় আরও তিন লক্ষ মানুষ। এই যাতায়াত পুরোটাই সড়ক-নির্ভর। তার সুযোগ নিচ্ছেন দালালরা। স্থানীয় প্রশাসনের দাবি, বুধবার অন্তত ৪০০টি দূরপাল্লার বাস ছেড়ে়ছে। সাধারণ সময়ের চেয়ে যা ছ’সাত গুণ বেশি। তাই এই বাজারে কামিয়ে নিতে চাইছেন দালালরাও।
রাজধানীর বাসিন্দাদের একাংশ এ ভাবে বেরিয়ে যাওয়ায় আসলে শাপে বর হয়েছে বলেই মনে করছেন হোটেল মালিক কুমার ঋষি। তাঁর মতে, ‘‘না হলে এত ক্ষণে শহরে জল আর খাবারের জন্য মারামারি শুরু হয়ে যেত।’’ কথাটা যে ভুল নয়, তা ভূ-কম্প পরবর্তী কাঠমান্ডু দর্শনের অভিজ্ঞতা থেকেই বোঝা যায়। গত সোমবার ভূমিকম্পের ৪০ ঘণ্টার মধ্যে যখন নেপালের রাজধানীতে পা দিয়েছিলাম, গোটা শহর ছিল কার্যত জনশূন্য। সব দোকানপাট বন্ধ। ভূমিকম্প হতে পারে ভেবে গোটা শহর তখন আশ্রয় নিয়েছে খোলা জায়গায় বা মাঠে। সে দিন সকালে আমার হোটেলের আশপাশে প্রায় আধ ঘণ্টা ঘুরে কেবল একটা মিষ্টির দোকান খোলা পেয়েছিলাম। খাবার বলতে শুধু মালপোয়া। স্থানীয় মানুষ কিনে নিয়ে ফের সেঁধিয়ে যাচ্ছিলেন নিরাপদ আশ্রয়ে। পরে দু’বেলা খাবারের জন্য ভরসা ছিল হোটেলের পাশের একটি দোকান। এক বোতল জল কিনতে এক সময়ে গুনতে হয়েছে ১০০ নেপালি টাকাও।
মঙ্গল-বুধবার কিছুটা নির্বিঘ্নে কাটায় গত কাল দুপুরের পর থেকে পরিস্থিতি পাল্টেছে। টুকটাক খুলেছে অন্য খাবারের দোকানগুলিও। তবে নতুন কিছু আসায় পুরনো মালই ভরসা। শাকসব্জির থেকে শুরু করে দ্বিগুণের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছে অনেক জিনিসের দাম। সড়়ক যাতায়াত খুলে যাওয়ায় দিন দু’য়েকের মধ্যেই গ্রাম থেকে নতুন সব্জি আসবে বলে আশা করছে কালিমাটি ফল ও সব্জি সমবায় বাজার কর্তৃপক্ষ। না হলে জিনিসের দাম আকাশ ছোঁবে বলে আশঙ্কা।
পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায় আজ থেকে কাঠমান্ডু ছাড়তে শুরু করেছেন বিদেশি উদ্ধারকারী দলগুলিও। চিন-জাপান, ফ্রান্স-সহ প্রায় ১৫ টি দেশের ১২০০ বিদেশি উদ্ধারকারী দল এত দিন কাজ করছিল বিভিন্ন এলাকায়। নেপাল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ভূমিকম্পের পাঁচ দিন পরে ধ্বংসস্তূপে কারও বেঁচে থাকা কার্যত অসম্ভব। তাই অবিলম্বে ওই দলগুলিকে নেপাল ছাড়তে নির্দেশ দিয়েছে সরকার। পরিবর্তে সরকার জোর দিয়েছে ত্রাণের কাজে।
কাঠমান্ডু স্বাভাবিক হতে শুরু করলেও প্রত্যন্ত এলাকাগুলির অবস্থা যে এখনও যথেষ্ট খারাপ, তা মানছে প্রশাসন। সিন্ধুপালচক, গোর্খা, লামজুং-এর মধ্যে বহু এলাকায় এখনও ত্রাণের কাজ সুষ্ঠু ভাবে শুরু করা যায়নি বলে অভিযোগ উঠেছে সরকারের অন্দরেই। পরিস্থিতি সামলাতে গত কাল সর্বদলীয় বৈঠক ডাকেন প্রধানমন্ত্রী। ত্রাণ বণ্টন নিয়ে অভিযোগ ঠেকাতে সর্বদলীয় প্রতিনিধিরা গোটা ব্যবস্থা তদারকি করবেন বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।