Kutupalong Refugee

Kutupalong Refugee Camp: উধাও অরণ্য, ছ’হাজার একর জুড়ে শুধু প্লাস্টিক শিট, উদ্বাস্তু শিবির এখন রোহিঙ্গা নগরী

রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রাণকেন্দ্র এই কুতুপালন শিবির। পাঁচ বছর পরে এ বার এখানে এসে দেখছি, একে আর শিবির বলা চলে না।

Advertisement

অগ্নি রায়

কক্সবাজার শেষ আপডেট: ১৪ জুন ২০২২ ০৬:২৫
Share:

কুতুপালন শিবিরে রোহিঙ্গা শিশুরা। নিজস্ব চিত্র

বছর ছয়েক আগেও ছিল গভীর জঙ্গল। হাতি এবং অন্য জন্তুদের নিভৃত খেলাধুলোর জায়গা। এখন কক্সবাজার-টেকনাফ হাইওয়ে থেকে ডান দিকে পাহাড়ি চড়াই-উতরাই বরাবর সেই জঙ্গল সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন। ৬ হাজার একর জুড়ে শুধু প্লাস্টিক শিট, কাঁচা-পাকা বাসস্থান, তাবুর খুঁটি, লক্ষ লক্ষ মানুষের ‘অরণ্য’। মাঝের অজস্র গলির দু’পাশে আনাজ, মাছ-মাংস, মণিহারি, ফলমূলের হাজার হাজার দোকান। আর প্রায় সব গলিতেই উপচে পড়ছে ঊলঙ্গ শিশুর দল।

Advertisement

রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রাণকেন্দ্র এই কুতুপালন শিবির। পাঁচ বছর পরে এ বার এখানে এসে দেখছি, একে আর শিবির বলা চলে না। পুরোদস্তুর রোহিঙ্গা নগরী। এক স্থানীয় আধিকারিকদের মতে এই অঞ্চলে জনসংখ্যা বাড়ছে বছরে ৫০ থেকে ৬০ হাজার। পাটিগণিত সহজ। সংসারে সদস্য যত বাড়বে, রাষ্ট্রপুঞ্জ-সহ বিভিন্ন এনজিও-র ফুড প্রোগ্রামের মাধ্যমে মাথা-পিছু রেশনও বাড়বে তত বেশি।

বাংলাদেশের তথ্যমন্ত্রী হাসান মাহমুদ বলছেন, “শরণার্থীদের গত পাঁচ বছর ধরে বিনামূল্যে থাকা-খাওয়ার পাশাপাশি চিকিৎসা পরিষেবাও দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, প্রতি বছর বিপুল জনসংখ্যা বাড়ছে রোহিঙ্গাদের। বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজের সঙ্গে এই জনগোষ্ঠী যুক্ত হয়ে পড়ছে। শুধু তাই-ই নয়, আমরা মনে করি ওই শিবিরগুলিতে সন্ত্রাসের বীজ বপন করতে সক্রিয় মৌলবাদী গোষ্ঠী। অবিলম্বে শরণার্থীদের মায়ানমারের ফেরত নেওয়া উচিত। আমরা বিশ্বাস করি, ভারত যদি সসম্মানে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য মায়ানমারকে বোঝায়, তা হলে খুবই সুবিধা হয়।” শুধু ভারতই নয়, চিনের প্রসঙ্গ তুলেও বাংলাদেশের মন্ত্রী বলেন, ‘‘এখানে সব চেয়ে বড় ভূমিকা পালন করতে পারে চিন। তাদের সঙ্গে মায়ানমারের বর্তমান জুন্টা সরকারের খুবই ভাল সম্পর্ক। ওদেরও বলেছি।”

Advertisement

কিন্তু মুখে এ কথা বললেও ঢাকা ভাল করেই জানে, পরিস্থিতি অত্যন্ত জটিল এবং আশু সুরাহা ভারতের হাতে নেই। বরং ভারত নিজেই রোহিঙ্গা সমস্যায় জর্জরিত। কাশ্মীর থেকে কিছু দিন আগেই বাংলাদেশে ঢুকেছেন নুর মহম্মদ এবং আরও অনেকে। তাঁর অভিযোগ, “জম্মুতে দিনমজুরের কাজ করতাম। কিন্তু কিছু দিন ধরে আমাদের উপরে চোটপাট এতই বেড়ে গেল, থাকতে পারলাম না। সবার সঙ্গে এসে এখানকার শিবিরে ভালই আছি। খেতে-পরতে পারছি।”

সাংবাদিকদের কনভয় দেখে চারপাশে কৌতূহলী চোখের মেলা। বাংলাদেশ সরকার যতটা সম্ভব চেষ্টা করছে এই শিবিরটি সামলে রাখার। ৩০টি ক্যাম্প এবং ১২টি খাদ্য সরবরাহ কেন্দ্রে ভাগ করে তৈরি হয়েছে প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র। ইউনিসেফ অসংখ্য তাঁবু খাটিয়ে চালাচ্ছে ঢালাও সরবরাহ। খোঁড়া হয়েছে সাড়ে আট হাজার গভীর নলকূপ। পাঁচটি নতুন পুলিশ থানাও তৈরি হয়েছে এখানকার নিরাপত্তার জন্য।

এমনই একটি স্বাস্থ্যকেন্দ্রের গিজগিজে ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে কথা হচ্ছিল জামালিদা বেগমের সঙ্গে। ২০১৬ সালের অক্টোবরে রাখাইন প্রদেশের মংডুতে সামরিক বাহিনী জামালিদার চোখের সামনে গুলি করে মেরেছিল তাঁর স্বামী আব্দুল শক্কুরকে। টানা এক সপ্তাহ গ্যারাজে লুকিয়ে থাকেন গ্রামের মহিলা-শিশুরা। এর মধ্যে চলে লুটতরাজ। “ঘর সামলাতে বাইরে আসতেই ওরা গাড়িতে তুলতে শুরু করে অল্পবয়সি মেয়েদের। নির্যাতন করতে থাকে। প্রতিবাদ করতে গেলে আমার উপরেও শুরু হয় অকথ্য অত্যাচার। কয়েক দিন হুঁশ ছিল না। তার পর কোনওমতে সীমান্ত পার হয়ে অনেকের সঙ্গে এখানে চলে আসি,” কথা বলতে বলতে কন্ঠরুদ্ধ হয়ে যায় জামালিদার।

উনিশ-বিশ একই গল্প এই শিবিরবাসীদের। তারই মধ্যে এক নতুন কথা শোনালেন নুরুল আমিন ওরফে উইন নেইংগ। গোটা শিবির তথা পাহাড়টিকে এক ঝলকে দেখার জন্য সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকার তৈরি করেছে এক সুউচ্চ মিনার বা ‘ওয়াচ টাওয়ার’। তার মাথায় চড়ে দেখা পাওয়া গেল রাখাইন প্রদেশের এই দ্বৈত নামধারীকে। যথেষ্ট ভাল ইংরেজিতে নুরুল বলেন, “পড়াশুনোয় ভাল দেখে বাড়ি থেকে একটা বাড়তি বার্মিজ নাম দিয়েছিল আমাকে। যাতে সব জায়গায় পক্ষপাতের শিকার না হতে হয়।” কিন্তু তাতেও শেষরক্ষা হয়নি। দেশের সেরা প্রতিষ্ঠানে মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সুযোগ পেয়েও এগোতে পারেননি। কোনও মতে ইংরেজিতে স্নাতক হয়েছেন লড়াই করে। “আমি রাখাইন শহরে একটি নরওয়ের এনজিও-তে কাজ করছিলাম। খবর আসে, আমাদের গ্রামের বাড়িঘর সব জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমার স্ত্রী আরও অনেকের সঙ্গে চার বাচ্চাকে নিয়ে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশ সীমান্তে চলে আসে। আমি আসি আরও পরে, রাতের অন্ধকারে গোপনে জলপথে।যাতে কোনও আওয়াজ না হয় সেই জন্য স্পিডবোটের পরিবর্তে করে নৌকায় চেপে।”

এই সুশিক্ষিত যুবকটির আর্তনাদ যেন ওয়াচ টাওয়ারের উপর থেকে ছড়িয়ে পড়ে রোহিঙ্গা নগরীর৩৬০ ডিগ্রি জুড়ে। “আমরা এখানে থাকতে চাই না। নিজের দেশেফিরে যাতে চাই। কিন্তু জুন্টা চায় না আমাদের নিতে। বাংলাদেশ সরকার চেষ্টা করছে আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীকে বোঝাতে। কিন্তু এখনও কোনও আশার আলো নেই।”

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তেফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন