জঙ্গি প্রশ্নে মমতাকে নিয়ে এগোবেন প্রধানমন্ত্রী মোদী

বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সন্ত্রাস রোধে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে পাশে চাইছেন। ঢাকার গুলশনের কাফেতে জঙ্গি হামলার পর সীমান্তবর্তী রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে চলছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এবং কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক।

Advertisement

জয়ন্ত ঘোষাল

নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ০৩ জুলাই ২০১৬ ০৩:৩৯
Share:

বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সন্ত্রাস রোধে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে পাশে চাইছেন।

Advertisement

ঢাকার গুলশনের কাফেতে জঙ্গি হামলার পর সীমান্তবর্তী রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে চলছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এবং কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অতিরিক্ত সচিব তথা পশ্চিমবঙ্গ ক্যাডারের প্রবীণ আমলা ভাস্কর খুলবে রাজ্য সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন। ঘটনার সম্ভাব্য কারণ, পরিণতি এবং ভবিষ্যৎ সতর্কতা নিয়ে দু’পক্ষের মধ্যে নিয়মিত কথা হচ্ছে।

এটা অবশ্য নতুন নয়। শ্রীলঙ্কায় তামিল জঙ্গি সংগঠন এলটিটিই-র বাড়বাড়ন্তের সময় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীরা যোগাযোগ করতেন তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী এবং তামিলনাড়ু সরকারের সঙ্গে। সরকারি মহলের বক্তব্য, এটাকে নেহাত রীতি হিসেবে দেখা ভুল। এ ভাবে এগোলে সমস্যার সমাধান অনেক সহজে করা যায়।

Advertisement

পিএমও সূত্রের বক্তব্য, বাংলাদেশের যা পরিস্থিতি, তাতে কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গের নিরাপত্তা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর উদ্বেগের যথেষ্ট কারণ রয়েছে। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের মোট দৈর্ঘ্য ৪০৯৬ কিলোমিটার। এর মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে সীমান্ত দৈর্ঘ্য ২২১৭ কিলোমিটার। অর্থাৎ দুই রাষ্ট্রের সীমান্ত দৈর্ঘ্যের অর্ধেকের বেশি পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে ভাগ করে বাংলাদেশ। এখন নতুন আশঙ্কা তৈরি করেছে বাংলাদেশে ধরপাকড় এড়াতে সীমান্ত টপকে এ দেশে জঙ্গিদের পালিয়ে আসার বিষয়টি। সে কারণেই পশ্চিমবঙ্গের পাশাপাশি সীমান্তবর্তী সবক’টি রাজ্যকেও সতর্ক থাকতে বলেছে কেন্দ্র। ঢাকায় ভারতের হাইকমিশনার হর্ষবর্ধনের মাধ্যমেও সে দেশের পরিস্থিতি এবং অন্যান্য বিষয়ে হাসিনা সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করছে দিল্লি।

এ দিন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে কথা বলার পাশাপাশি টুইটে মোদী লিখেছেন, ‘‘এই শোকের সময় ভারত দৃঢ় ভাবে বাংলাদেশের ভাই-বোনেদের পাশে দাঁড়াচ্ছে।’’ নিহতদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা এবং আহতদের দ্রুত আরোগ্য কামনা করে মোদী লিখেছেন, ‘‘ঢাকায় এই আক্রমণের ঘটনায় ব্যথা জানানোর ভাষা নেই। আমি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে কথা বলেছি এবং এই ঘটনার তীব্র নিন্দা করেছি।’’

বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে শীঘ্রই কথা বলবেন মোদী। ১৮ জুলাই থেকে শুরু হচ্ছে সংসদের বাদল অধিবেশন। সূত্রের খবর, অধিবেশন শুরু হওয়ার পরে মুখ্যমন্ত্রী দিল্লি আসবেন। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর বৈঠকে বাংলাদেশের বিষয়টি গুরুত্ব পেতে চলেছে। প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ের বক্তব্য, মোদী সরকার ক্ষমতায় আসার পরে মমতা যে ভাবে বাংলাদেশ সমস্যা সমাধানে সদর্থক পদক্ষেপ করেছেন, তাতে কেন্দ্র খুশি। তাই উভয় পক্ষের মধ্যে গোয়েন্দা তথ্যের আদানপ্রদান, সীমান্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত করার মতো বিষয়গুলি মাথায় রেখে এগোতে চাইছে কেন্দ্র। এর আগে মনমোহন সিংহের জমানায় তৎকালীন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রসচিব অনিল গোস্বামী দু’বার কলকাতায় মমতার বাড়ি গিয়ে সীমান্ত পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেছিলেন। প্রাক্তন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিবশঙ্কর মেননও মমতাকে বাংলাদেশ সীমান্তে জঙ্গি তৎপরতা নিয়ে রিপোর্ট দিয়েছিলেন।

পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের সীমান্তের একটি বড় অংশে এখনও কাঁটাতারের বেড়া নেই। এই পরিস্থিতিতে বিশেষ ভাবে সতর্ক করা হয়েছে বিএসএফকে। সীমান্ত নিরাপত্তার প্রশ্নে সুষ্ঠু সমন্বয় গড়ে তুলতে রাজ্য পুলিশের সঙ্গে আজ বৈঠক করেন বিএসএফ কর্তারা।

রাজ্য সরকার সূত্রের খবর, গোটা বিষয়টি নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী ওয়াকিবহাল। ক’দিন আগেই ভারতে বাংলাদেশের হাইকমিশনার সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলি কলকাতায় গিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছেন। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক জানিয়েছে, ইতিমধ্যেই বাংলাদেশের জঙ্গি হামলা নিয়ে মার্কিন গোয়েন্দা দল এফবিআই কেন্দ্রের হাতে বেশ কিছু তথ্য তুলে দিয়েছে। সেই তথ্য কেন্দ্রের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে। যাতে সতর্ক থাকতে পারে তারা। বাংলাদেশের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে মমতা এ দিন সংশ্লিষ্ট পুলিশকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। কেন্দ্রীয় সরকার এবং বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে সহযোগিতার মাধ্যমে চলতে চাইছেন তিনি।

গরু এবং নিষিদ্ধ কাশির সিরাপ চোরাচালান নিয়ে দু্’দেশের সীমান্ত বরাবরই উত্তপ্ত থেকেছে। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে জঙ্গিদের বাড়বাড়ন্তে বেশি উদ্বিগ্ন মোদী সরকার। এই উদ্বেগও নতুন নয়। পশ্চিমবঙ্গে বাম জমানায় যখন রাজ্যের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, তখন তৎকালীন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লালকৃষ্ণ আডবাণী বারবার বৈঠক করেছেন তাঁর সঙ্গে। সে সময় কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্যকে জানিয়েছিল, সীমান্তবর্তী কিছু মাদ্রাসায় মৌলবাদের রমরমা বাড়ছে। সে সময় রাজ্য সরকারও বিষয়টি খতিয়ে দেখে কিছু পদক্ষেপ করে।

কিন্তু সেই পদক্ষেপ যে যথেষ্ট নয়, তার প্রমাণ মিলেছে ২০১৪ সালে বর্ধমানের খাগড়াগড়ে বিস্ফোরণের পর। অভিযোগ, বাংলাদেশের জিহাদিরা এখনও প্রশিক্ষণের জন্য মূলত সীমান্ত-লাগোয়া এলাকাগুলিকেই বেছে নিচ্ছে। বর্ধমানের শিমুলিয়ায় বাংলাদেশি জামাতের নেতা-কর্মীদের মৌলবাদী তত্ত্বের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, এমন তথ্যও উঠে এসেছিল এনআইএ-র প্রাথমিক তদন্তে। এই পরিস্থিতিতে পশ্চিমবঙ্গের ভূকৌশলগত অবস্থানের কথা মাথায় রেখে স্বল্প এবং দীর্ঘমেয়াদি— দু’ধরনের ব্যবস্থাই নেওয়ার কথা ভাবছে কেন্দ্র। এবং তা রাজ্য সরকারের সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে। প্রধানমন্ত্রী একাধিক বার বিভিন্ন মঞ্চে জানিয়েছেন, পূর্ব যদি শক্তিশালী না হয়, তা হলে গোটা ভারতই দু্র্বল থেকে যাবে। ‘অ্যাক্ট ইস্ট’-এর মাধ্যমে তিনি পূর্বাঞ্চলের উন্নয়ন, তথা নিরাপত্তার প্রশ্নটির দীর্ঘমেয়াদি সমাধান করতে চাইছেন।

মার্কিন বিদেশসচিব হিলারি ক্লিন্টন যখন কলকাতায় এসেছিলেন, তখন মমতার সঙ্গে বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে দু’জনের কথা হয়। বাংলাদেশের রণকৌশলগত অবস্থান ও সে দেশের জঙ্গি তৎপরতা নিয়েও তখন কথা হয়েছিল। সম্প্রতি কলকাতা সফরে এসে মার্কিন বিদেশ দফতরের রাজনীতি বিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি টমাস শ্যানন সীমান্তে নিরাপত্তা ও জঙ্গি দমনের মতো বিষয়গুলি নিয়ে আলোচনা করেন। মার্কিন প্রতিনিধিরা মুখ্যমন্ত্রীকে জানান, লস্কর, জামাত, আইএস ও পাক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই বাংলাদেশে সক্রিয় রয়েছে বুঝতে পেরে ধরাপকড় শুরু করেছে শেখ হাসিনা সরকার। এর ফলে সীমান্ত পার হয়ে ওই জঙ্গিদের পশ্চিমবঙ্গে ঢুকে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার জানিয়েছে, তারা বিষয়টি নিয়ে সতর্ক।

প্রথমে তুরস্কের বিমানবন্দরে ও তার দু’দিনের মাথায় বাংলাদেশে জঙ্গি হামলার প্রেক্ষিতে দেশের সব বিমানবন্দরকে আজ সতর্ক করে দিয়েছে কেন্দ্র। বিশেষ ভাবে সতর্ক করা হয়েছে কলকাতা বিমানবন্দরকে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন