তিস্তা ঘিরে আবেগ বুঝলেন ঢাকায় পা দিয়ে

গঙ্গা পারে মুকুল রায়কে নিয়ে অশান্তি চরমে। তার মধ্যে আজ পদ্মা পারে এলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, যেখানে তাঁর জন্য অপেক্ষা করছে তিস্তা নিয়ে বিপুল প্রত্যাশা। মুকুল-পর্ব সামলাতে কড়া বার্তা দিয়ে কলকাতা ছেড়েছেন। ঢাকায় নেমেই পড়তে হল তিস্তা-আবেগের মুখে। সরাসরি তার কোনও জবাব দেননি তিনি। না এ-পারে, না ও-পারে। কলকাতায় বলে এসেছেন, “তিস্তা নিয়ে কিছু বলছি না। তবে ছিটমহল নিয়ে নিশ্চয়ই কথা হবে।” আর ঢাকায় বললেন, “অনেক আন্তরিকতা নিয়ে ঢাকায় এসেছি। মনে হয়, নিজের ঘরে এসেছি।”

Advertisement

অগ্নি রায়

ঢাকা শেষ আপডেট: ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০৩:৩১
Share:

ঢাকা বিমানবন্দরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে স্বাগত জানাচ্ছেন বাংলাদেশের বিদেশ প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম। বৃহস্পতিবার রাতে।— নিজস্ব চিত্র।

গঙ্গা পারে মুকুল রায়কে নিয়ে অশান্তি চরমে। তার মধ্যে আজ পদ্মা পারে এলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, যেখানে তাঁর জন্য অপেক্ষা করছে তিস্তা নিয়ে বিপুল প্রত্যাশা। মুকুল-পর্ব সামলাতে কড়া বার্তা দিয়ে কলকাতা ছেড়েছেন। ঢাকায় নেমেই পড়তে হল তিস্তা-আবেগের মুখে। সরাসরি তার কোনও জবাব দেননি তিনি। না এ-পারে, না ও-পারে। কলকাতায় বলে এসেছেন, “তিস্তা নিয়ে কিছু বলছি না। তবে ছিটমহল নিয়ে নিশ্চয়ই কথা হবে।” আর ঢাকায় বললেন, “অনেক আন্তরিকতা নিয়ে ঢাকায় এসেছি। মনে হয়, নিজের ঘরে এসেছি।”

Advertisement

ফলে শাহবাগ চত্বর থেকে বাংলা অ্যাকাডেমির একুশের বইমেলা, প্রেস ক্লাবের গুঞ্জন থেকে বনানীর অভিজাত পাড়া, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়াদের রাস্তা ছড়ানো আড্ডা সর্বত্র প্রশ্নটা রয়েই গেল: তিস্তার বরফ শেষ পর্যন্ত গলবে কি?

ঢাকায় কাউন্টডাউন শুরু হয়ে গিয়েছে ‘একুশে’-র ভাষা উৎসবের। পাল্লা দিয়ে ঔৎসুক্য বাড়ছে সতেরো বছরের ব্যবধানে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের চলতি সফরটিকে ঘিরেও। আশা নিয়ে মমতার মুখের দিকে তাকিয়ে রয়েছে দিল্লি এবং ঢাকা। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মিডিয়া উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী যেমন বলছেন, “পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বাংলাদেশের নেতৃত্বের ইতিবাচক আলোচনায় নরেন্দ্র মোদীর বাংলাদেশ সফরের ভিতও কিছুটা তৈরি হবে!”

Advertisement

আগামী ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবসে নরেন্দ্র মোদী উপস্থিত থাকুন, সেটা একান্ত ভাবে চাইছে হাসিনা সরকার। মোদী নিজেও বাংলাদেশ সফরে আগ্রহী। কিন্তু মোদী-হাসিনা বৈঠকের সম্ভাবনার সঙ্গে আগামী দু’দিনের আলোচনায় ‘ইতিবাচক অগ্রগতি’ যে এক সুতোয় জড়িয়ে রয়েছে, সে বিষয়ে নিশ্চিত ভারতীয় দুতাবাস এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়।

বল নিঃসন্দেহে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কোর্টে। তাঁকেই স্থির করতে হবে কী ভূমিকা নেবেন তিনি। ইতিমধ্যেই মমতার সফরকে প্রায় রাষ্ট্রীয় সফরের মর্যাদা দিয়েছে আওয়ামি লিগ সরকার। বিদেশ মন্ত্রকের মিডিয়া ডিরেক্টর নৃপেন্দ্রচন্দ্র দেবনাথ জানাচ্ছেন, “কোনও দেশের প্রধানমন্ত্রী এলে যে ভাবে নিরাপত্তা দেওয়া হয়, সেই মর্যাদা দেওয়া হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীকে। তাঁর জন্য স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্স-এর ব্যবস্থা করা হয়েছে। গত মাসেই চিনের বিদেশমন্ত্রী এসেছিলেন। তাঁর জন্য কিন্তু শুধুমাত্র পুলিশি নিরাপত্তা দেওয়া হয়েছিল!”

এই ‘বাড়তি খাতির’ যে শুধুমাত্র ব্যক্তিগত সৌজন্যের কারণে নয়, মমতা এ কথা বিলক্ষণ জানেন।

২০১১ সালে তিস্তা চুক্তির প্রতিবাদে তিনি বাংলাদেশ সফর বাতিল করার পর তৃণমূল নেত্রীর প্রতি ক্ষোভ তৈরি হয়েছে বাংলাদেশে। ১৯৯৮ সালে আওয়ামি লিগের সুবর্ণজয়ন্তী অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এসে যে উষ্ণতার পরিচয় তিনি পেয়েছিলেন (তোপখানা রোড ভিড়ে ভিড়াক্কার হয়ে গিয়েছিল, মমতা হেঁটেছিলেন জনতার সঙ্গে) তা এখন নেই। কিন্তু তবুও সীমান্ত সংলগ্ন রাজ্যটির নেত্রীর কাছ থেকে শুধু তিস্তা নয়, অন্যান্য কিছু বিষয়েও ইতিবাচক বার্তা পেতে চাইছে বাংলাদেশ।

হাসিনা সরকারের এক মন্ত্রীর কথায়, “মোট তিনটি বিষয় নিয়ে ওঁর সদর্থক বার্তা আমরা চাইব। প্রথমটা অবশ্যই তিস্তা চুক্তি। দ্বিতীয়ত, জামাতে ইসলামির সঙ্গে তাঁর দলের দহরম মহরম নিয়ে যে অভিযোগ উঠেছে, আমরা চাই তা মুছতে ঢাকার মাটিতে দাঁড়িয়ে তিনি সন্ত্রাস এবং মৌলবাদ-বিরোধী কোনও কঠোর বিবৃতি দিন, যা হাসিনার হাতকে শক্ত করবে। তৃতীয় যে বিষয়টা আমরা চাইব, তা হল দীর্ঘদিনের বকেয়া ছিটমহল হস্তান্তরের কাজে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী সক্রিয় ভূমিকা নিন।” আসার আগে কলকাতায় মমতা বলেন, “ছিটমহলে সব জমি সমস্যার সমাধান হোক। ১৭ হাজার মানুষ আছেন। তাদের ল্যান্ড সেটেলমেন্ট করতে হবে। পুনর্বাসন প্যাকেজও আছে। কেন্দ্রকে বলেছি, এদের জীবিকার ব্যবস্থাও করতে হবে।”

ভাষা দিবসের আগে নিরাপত্তার মোড়কে ঢাকার শহিদ মিনার। বৃহস্পতিবার বাপি রায়চৌধুরীর তোলা ছবি।

এ কথা ঠিকই যে, কোনও বিষয়েই কোনও আনুষ্ঠানিক ঘোষণার প্রত্যাশা করছেন না ঢাকা। ইকবাল সোবহান চৌধুরীর মতে, “আনুষ্ঠানিক ভাবে কোনও পূর্ব নির্ধারিত আলোচ্যসূচি নিয়ে বৈঠকে বসবেন না শেখ হাসিনা এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। যা কিছু হওয়ার ঘরোয়া ভাবেই হবে। দু’জনেই বহু দিনের পরিচিত। যার ফলে ইতিবাচক রাজনৈতিক অভিমুখ তৈরি হবে বলে আশা করা যায়।”

তবে ঘুরে ফিরে বাংলাদেশের দিক থেকে আলোচনায় যে তিস্তা জল-বণ্টনই যে প্রাধান্য পাবে, সেটাও স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। এ দেশের নদী বিশেষজ্ঞদের মতামতের নির্যাস আরও এক বার তুলে ধরা হবে মমতার সামনে। রাজনৈতিক সূত্রের খবর, সম্প্রতি যে রিপোর্টটি কল্যাণ রুদ্র রাজ্য সরকারকে জমা দিয়েছেন, সেখানে পশ্চিমবঙ্গের ক্ষতি না করে বাংলাদেশকে ৫০ শতাংশ জল দেওয়ার দিশা নির্দেশ করা হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের অন্য এক জল বিশেষজ্ঞ তথা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোলের অধ্যাপক প্রণবকুমার রায়ও এমনই কিছু দিশা দেখিয়েছেন। তাঁর বক্তব্য, তিস্তার জল-বণ্টন নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে বহু দিন ধরে কিছু ভুল ধারণা রয়েছে। তার একটি হল, রাজ্যে প্রবল জলাভাব রয়েছে। দুই, ভূগর্ভস্থ জলের পরিমাণ ক্রমশই নেমে গিয়ে বড় ধরনের বিপদের দিকে যাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ। তাঁর মতে, এই দু’টি ভুল ধারণার বশবর্তী হয়েই রাজ্য সরকার বাংলাদেশের সঙ্গে জল-বণ্টনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে নেতিবাচক মনোভাব নিয়েছে। প্রণববাবুর মতে, অযথা আতঙ্কিত না হয়ে সঠিক ম্যানেজমেন্ট প্রযুক্তি ব্যবহার এবং যথেষ্ট জল মজুত রাখার ব্যবস্থা করলে, খরার সময়েও নদী অববাহিকা সবুজ থাকবে।

তবে এ সবই বিশেষজ্ঞদের তত্ত্ব। আলোচনার টেবিলে বসে বাংলাদেশের দাবির মুখে মমতা বিষয়টি নিয়ে কোনও নরম অবস্থান নেন কি না, আগামী দু’দিনের মধ্যেই তা স্পষ্ট হয়ে যাবে। রাতে ঢাকা বিমানবন্দরে নেমে তিনি অবশ্য বলেছেন, এসেছেন প্রাণের টানে, যাবতীয় ইতিবাচক মানসিকতা নিয়েই। বাংলাদেশ তো বটেই, দিল্লিরও এখন নজরে তাঁর প্রতিটি পদক্ষেপ। সাংস্কৃতিক যোগাযোগের বিষয়টিও মমতার এই সফরে যে বিশেষ গুরুত্ব পাবে, তা তাঁর সঙ্গী নির্বাচনেও স্পষ্ট। রয়েছেন দেব, প্রসেনজিৎ, মুনমুন সেন, গৌতম ঘোষ, নচিকেতা, ইন্দ্রনীল সেন, ব্রাত্য বসুরা। এসেছেন দুই শিল্পপতি হর্ষ নেওটিয়া, সঞ্জীব গোয়েন্কাও। আলোচনার সময়ে থাকবেন মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম ও মুখ্যসচিব সঞ্জয় মিত্র।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন