তাপমাত্রা মাইনাস ২০-র নীচে। কোনও রকমে খড়কুটো জ্বালিয়ে তাকে বাগে আনার চেষ্টা এক শরণার্থীর। ছবি: এএফপি।
তাপমাত্রা কোথাও মাইনাস ২০! কোথাও বা মাইনাস ১৮! কোথাও আবার মাইনাস ১৩! সেই সঙ্গে প্রবল হাওয়া।
তারই মধ্যে সবে ম্যাসিডনিয়া-গ্রিস সীমান্ত পেরিয়েছে ইরাকের পরিবারটি। সাত জনের দলে তিনটে শিশু। তাদের প্রত্যেকের বয়স পাঁচ বছরের নীচে। লাগেজের সঙ্গে তিন জনই তাদের বাবা-মায়ের পিঠে রয়েছে। ওদেরই এক জন শীতপোশাক পরার পরেও ঠান্ডায় কাঁপছিল ঠকঠক করে। কান্না থামাতে পাশে পাশে হেঁটে যাওয়া তাদের এক আত্মীয় ওই শিশুটিকে বল দেখায়। বরফের বল। বলটি তার হাতে দিতে গিয়েও বার বার কাছ থেকে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছিল। কান্না থামিয়ে হেসে উঠছিল শিশুটি। ‘বল দাও’ বলে হাত বাড়িয়ে দিচ্ছিল সে বার বার। কিন্তু, তার হাতে দেওয়া মাত্রই এক ঝটকায় বলটা সে ছুড়ে ফেলে দেয়। কারণ? শিশুটি জানতই না ‘স্নো’ ঠান্ডা হয়। ঠান্ডা হাতে আরও শীতল স্পর্শে সে আরও তীব্র স্বরে কেঁদে ওঠে।
শুধু শিশুটি নয়, তার বাবা-মা এমনকী মধ্য এশিয়া থেকে আসা এই সব শরণার্থীদের বেশির ভাগেরই বরফের সঙ্গে সরাসরি কোনও পরিচয় এত দিন ছিল না। হয় বই নয়তো বা খবরের কাগজের ছবি এবং সিনেমার পর্দাই ছিল তাদের বরফ পরিচিতির মাধ্যম। বরফের মধ্যে নায়ক-নায়িকারদের রোম্যান্স তাদের আনন্দ দিত। কিন্তু, জীবনকে বাজি রেখে একটু আশ্রয়ের খোঁজে মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন দেশ ছেড়ে অনেক কষ্টে ইউরোপে পৌঁছনো মানুষগুলোর কাছে বরফ এখন একটা ত্রাস। সারা দিন ঝির ঝির করে তুষারপাত হয়েই চলেছে। সেই সঙ্গে ঠান্ডার হাওয়ার কামড়। সব মিলিয়ে গোদের উপর বিষফোঁড়া অবস্থা তাঁদের। জীবনের প্রথম বরফ দেখার অভিজ্ঞতাটা তাঁদের কাছে ভয়ঙ্কর হয়েই থাকবে সারা জীবন!
• হাড়কাঁপানো ইউরোপে এ কেমন অবস্থায় কাটাচ্ছেন শরণার্থীরা
ছবি দেখতে ক্লিক করুন
শুধু রাষ্টপুঞ্জের আবহাওয়া এজেন্সি নয়, অন্য সংস্থাগুলিও বারে বারে পূর্বাভাসে জানাচ্ছে তাপমাত্রা আরও নামতে পারে। মাইনাস ২০-রও নীচে! এর মধ্যেই বেশ কয়েক কিলোমিটার করে হাঁটতে হচ্ছে শরণার্থীদের। রাত কাটাতে হচ্ছে স্টেশনে। এমনকী, ফুটপাথেও। সার্বিয়া-ম্যাসিডোনিয়া সীমান্ত থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার হেঁটে সার্বিয়া যাওয়ার ট্রেন ধরতে হয়। প্রবল তুষারপাতের মধ্যেই দিন-রাত এক করে হেঁটে চলেছেন শরণার্থীরা। নারী-পুরুষ-শিশু— সকলেই হাঁটছে। একটু আশ্রয়ের খোঁজে। ত্বক ফেটে চৌচির। কারও কারও মুখের ত্বক থেকে রক্ত ঝরছে! ফুটিফাটা ঠোঁট। হাতে-পায়েরও একই অবস্থা। প্রবল হাওয়ার শব্দে নিজেদের মধ্যে কথাও বলা যাচ্ছে না। এক ভয়ানক পরিস্থিতি। সীমান্ত পেরোনোর আনন্দে একটা সময় এই জায়গাতেই শরণার্থীদের মুখে হাসিটুকু দেখা যেত। এখন সেই সার্বিয়া-ম্যাসিডোনিয়া সীমান্ত পেরিয়ে কাঁদছেন অনেকে। কষ্টে। ঠান্ডা সহ্য করতে না পেরে!
সীমান্ত পেরিয়ে হেঁটে প্রিসেভো পৌঁছে সেখান থেকে ট্রেন ধরে প্রথমে ক্রোয়েশিয়া। তার পর অন্তিম গন্তব্য জার্মানি পৌঁছনোর আগে স্লোভেনিয়া এবং অস্ট্রিয়া পেরোনো। তাঁদের সম্বল বলতে কয়েকটা মাত্র ইউরো। তার আগেই ঠান্ডা না কেড়ে নেয় প্রাণ! এই আশঙ্কা নিয়েই তারা ঠান্ডার মধ্যেই এগিয়ে চলেছেন জার্মানির উদ্দেশে। তাও তো তারা ইউরোপ পৌঁছেছেন। এর আগে তো অনেকে সেটাও পারেননি। তুরস্কের বদরামের সমুদ্রসৈকতে ভেসে উঠেছিল ছোট্ট আয়লানের দেহ। এর আগেও শরণার্থীদের দুরবস্থা, মৃত্যুর খবর এসেছে। একের পর এক সংকট পেরিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজটা চলছেই।