ভূমিকম্পে এভারেস্টেরও ঠাঁইবদল

পাতালের উথালপাথালে ভূপৃষ্ঠ লন্ডভন্ড। এমনকী, তা রেয়াত করেনি বিশ্বের শীর্ষতম পর্বতশিখরকেও! চিনের ভূ-সর্বেক্ষণ বিভাগের দাবি, নেপালে এপ্রিলের সেই সাংঘাতিক ভূমিকম্পের ধাক্কায় খোদ মাউন্ট এভারেস্ট দক্ষিণ-পশ্চিমে অন্তত তিন সেন্টিমিটার সরে গিয়েছে। উপগ্রহ-চিত্র বিশ্লেষণ করেই তারা এ হেন সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে বলে মঙ্গলবার জানিয়েছে চিনের সরকারি সংবাদসংস্থা জিনহুয়া।

Advertisement

দেবদূত ঘোষঠাকুর

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৭ জুন ২০১৫ ০২:২৮
Share:

পাতালের উথালপাথালে ভূপৃষ্ঠ লন্ডভন্ড। এমনকী, তা রেয়াত করেনি বিশ্বের শীর্ষতম পর্বতশিখরকেও! চিনের ভূ-সর্বেক্ষণ বিভাগের দাবি, নেপালে এপ্রিলের সেই সাংঘাতিক ভূমিকম্পের ধাক্কায় খোদ মাউন্ট এভারেস্ট দক্ষিণ-পশ্চিমে অন্তত তিন সেন্টিমিটার সরে গিয়েছে।

Advertisement

উপগ্রহ-চিত্র বিশ্লেষণ করেই তারা এ হেন সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে বলে মঙ্গলবার জানিয়েছে চিনের সরকারি সংবাদসংস্থা জিনহুয়া। প্রসঙ্গত, মার্কিন ও ইউরোপীয় ভূতত্ত্ববিদ মহলের একাংশের মতে, গত ২৫ এপ্রিলের ৭.৮ রিখটারমাত্রার নেপাল-কেন্দ্রিক ভূকম্পটির জেরে এভারেস্ট শৃঙ্গের উচ্চতা কিছুটা খাটো হয়ে গিয়েছে। সেই অভিমত নস্যাৎ করে চিনের ভূ-সর্বেক্ষণ বিভাগ (ন্যাশনাল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অব সার্ভেয়িং, ম্যাপিং অ্যান্ড জিওইনফরমেশন) জানিয়েছে, মাউন্ট এভারেস্টের উচ্চতায় (৮৮৪৮ মিটার) হেরফের ঘটেনি। তবে ভূকম্প তাকে বিলক্ষণ নাড়িয়ে দিয়েছে। দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে কিছুটা সরে গিয়েছে মাউন্ট এভারেস্ট।

‘কিছুটা’ মানে অন্তত তিন সেন্টিমিটার। চিনের ভূ-বিশেষজ্ঞদের হিসেবে, হিমালয়ের নীচের ভূস্তরে ইউরেশীয় প্লেট ও ইন্ডিয়ান প্লেটে প্রতিনিয়ত ঘর্ষণের দরুণ মাউন্ট এভারেস্ট ফি বছর গড়ে চার সেন্টিমিটার উত্তর-পূর্বে সরছিল। এই ‘স্বাভাবিক সরণের’ পরিণামে বিশ্বের সর্বোচ্চ শিখর গত দশ বছরে উত্তর-পুবে নয়-নয় করে ৪০ সেন্টিমিটার সরে এসেছে। কিন্তু ২৫ এপ্রিলের তীব্র ভূকম্পের অভিঘাত হয়েছে পুরোপুরি উল্টো দিকে আর তাই দক্ষিণ-পশ্চিমে স্থানবদল। স্বাভাবিক সরণের বিপরীতমুখী এই প্রাকৃতিক অভিঘাতের সুদূরপ্রসারী প্রভাব কী, চিনা ভূ-তাত্ত্বিকেরা অবশ্য তার আন্দাজ দিতে পারেননি। ‘‘হিমালয়ের ভূগোলে যে কোনও পরিবর্তন পূর্ব ও দক্ষিণ এশিয়ার জীব-বৈচিত্র্য এবং পরিবেশকে প্রভাবিত করে। এ ক্ষেত্রে পরিণতি দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে।’’— মন্তব্য এক চিনা বিজ্ঞানীর।

Advertisement

কিন্তু ভূমিকম্পের ধাক্কায় এভারেস্ট কি সত্যিই সরে যেতে পারে? কী বলেন এ দেশের বিশেষজ্ঞেরা?

খড়্গপুর আইআইটি’র ভূ-বিজ্ঞানী শঙ্করকুমার নাথের ব্যাখ্যা, ‘‘এপ্রিলের ভূকম্পে ইন্ডিয়ান প্লেটটি ইউরেশীয় প্লেটের নীচে প্রায় বারো ফুট ঢুকে গিয়েছিল। এতে কম্পনের উৎসস্থলের আশপাশের জমি যেমন ঠেলে উঠেছে, তেমন আড়াআড়ি ধাক্কাও খেয়েছে।’’ তাই এভারেস্ট কিছুটা সরে গিয়ে থাকলে আশ্চর্যের কিছু দেখছেন না শঙ্করবাবু। জিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া (জিএসআই)-এর অবসরপ্রাপ্ত ডেপুটি ডিরেক্টর জেনারেল জ্ঞানরঞ্জন কয়ালও বিস্মিত নন। ‘‘২৫ এপ্রিলের তীব্র কম্পনের কেন্দ্রস্থলটি মাটির খুব গভীরে ছিল না। এমন ক্ষেত্রে মাটির উপরিস্তরে সরণ অস্বাভাবিক নয়।’’— পর্যবেক্ষণ জ্ঞানরঞ্জনবাবুর।

বস্তুত ভূ-বিজ্ঞানীরা অনেকে জানাচ্ছেন, ইন্ডিয়ান প্লেট খুব গতিতে ইউরেশীয় প্লেটের নীচে ঢুকে গেলে অবস্থানের সুবাদেই এভারেস্ট শৃঙ্গে প্রভাব পড়তে বাধ্য। এক বিশেষজ্ঞের কথায়, ‘‘যে ভূমিকম্পে ছোটখাটো একটা পরমাণু বোমার সমান শক্তি নির্গত হয়েছিল, সেখানে পর্বতশৃঙ্গে এমন ভৌগোলিক পরিবর্তন হতেই পারে।’’

এ প্রসঙ্গে ২০০৪-এর বিধ্বংসী সুনামির দৃষ্টান্ত উঠে আসছে। এক বিজ্ঞানী বলেন, ওই বিপর্যয়ের মাসখানেক বাদে উপগ্রহ-চিত্রে ধরা পড়ে, আন্দামান দ্বীপভূমি ভারতের দিকে কিছুটা সরে এসেছে, ইন্দোনেশিয়ার সঙ্গে দূরত্ব সামান্য বেড়েছে। ‘‘আসলে একটা বড় ভূমিকম্পে তামাম ভূস্তরে যে চাপ পড়ে, তাতে নীচের স্তরে ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়। ভূস্তরকে স্থিতিশীল করতে ল্যান্ড মাসে কিছু পরিবর্তন ঘটে। ছোট ছোট ঝাঁকুনি (আফটারশক) সেই সুস্থিতি নিয়ে আসে।’’— দাবি তাঁর। ওঁরা জানিয়েছেন, ২৫ এপ্রিলের মূল কম্পনের ধাক্কায় কাঠমান্ডুর কাছে মাটি উল্লম্ব ভাবে প্রায় এক ফুট উঠে গিয়েছিল। তাতেই ভূস্তরের ভারসাম্য পুরোপুরি টলে যায়।

২৫ এপ্রিলের ৭.৮ রিখটার ও ১২ মে’র ৭.৩ রিখটারের দু’টি ভূমিকম্পের পরে প্রায় শ’দেড়েক আফটারশক হয়েছে। এতে নেপালের পায়ের তলার মাটি ধীরে ধীরে সুস্থির হলেও কিছু পরিবর্তন আপাতত স্থায়ী হয়ে রয়ে গিয়েছে। যেমন একাধিক হিমবাহের গলন, কয়েকটি নদীর গতিপথ পাকাপাকি ভাবে বদলে যাওয়া ইত্যাদি।

মাউন্ট এভারেস্টের ঠাঁইবদলও এ বার জুড়ে গেল সেই তালিকায়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন