১৯৬১। — গেটি ইমেজেস
এ বছর জুলাইয়ে যখন নিউ ইয়র্কে আছি, হঠাৎ খবর পেলাম, ব্রুকলিনে গাইতে আসছেন ডিলান। তিন ঘণ্টার শো, একাই গাইবেন। খোঁজ নিয়ে দেখলাম, অবাক কাণ্ড! টিকিটের দাম খুব বেশি নয়! তা হলে তো এ সুযোগ ছাড়ার মানেই হয় না! প্রায় কেটেই ফেলছিলাম টিকিট, শেষ মুহূর্তে হাত আটকে গেল আপনা থেকে। থাক। এত এত দিন ধরে এই একটি মানুষের একখানা মূর্তি তৈরি হয়েছে বুকের ভেতর, সেটাকে আর এই বয়সে এসে মিলিয়ে দেখতে ইচ্ছে করল না। পারফরম্যান্সের দিক থেকে ডিলান তাঁর শ্রেষ্ঠ সময় পেরিয়ে এসেছেন, কিন্তু আমার ভাবনায় তিনি চিরযৌবনের অধিকারী। এই তীব্র ভালবাসার অভিমানী দূরত্বটুকুই তো এক জন অনুরাগীর সম্পদ।
দূরত্ব বললাম বটে, কিন্তু আমরা যখন বড় হচ্ছি, তখন হাতে গোনা আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে বব ডিলান ছিলেন প্রথম সারির। সকলের নয় অবশ্য, যারা একটু আধটু গানবাজনার খোঁজখবর করি, তাদের বন্ধু হয়ে উঠতে ডিলানের যে-কোনও একখানা গানই যথেষ্ট ছিল। কত কত ঝগড়ার, প্রেমের, চিঠি চালাচালির, মন খারাপের আর কান্নার সাক্ষী থেকেছেন দূরবর্তী এই ডিলান, যিনি আদতে ভীষণ কাছের একজন মানুষ। পরে ভেবে দেখেছি, কেন হয়েছে এমনটা? কিছু কিছু মানুষের শিল্পের সামনে দাঁড়ালে মনে হয়, আমি তো এই কথাই বলতে চেয়েছিলাম। ডিলানের গান কিন্তু তার উল্টো পথেই হেঁটেছে। তাঁর কলম, তাঁর গিটারের সামনে গিয়ে দাঁড়ালে মনে হয়েছে, এত দিন যা ভেবেছি, এ তো তা নয়! কিন্তু এ বার থেকে এইটেই আমারও কথা। আমাদের সকলকে নিজের ছাঁচে আস্তে আস্তে ঢেলে নিচ্ছিলেন গান লিখিয়ে খ্যাপাটে মানুষটি, যাঁর আসল নাম রবার্ট অ্যালেন জিমারম্যান।
মার্কিন, কিন্তু ১৯৪১-এ জন্মানো এই শিল্পীকে তথাকথিত ‘মার্কিন’ তকমার আওতায় ফেলা যাবে না কিছুতেই। রক অ্যান্ড রোল যখন আমেরিকার মানচিত্র বদলে দিচ্ছে, ঠিক সেই সময়ে দাঁড়িয়ে তিনি তুলে আনছেন মাটির গান। কারণ তাঁর ভাবনায়, রক অ্যান্ড রোল জীবনবিচ্ছিন্ন। তার জনপ্রিয়তা আছে, শিকড় নেই। আর সেই শিকড় খুঁজতেই ডিলানের খোঁজ শুরু মার্কিন লোকসঙ্গীতের পাড়ায় পাড়ায়। সেই মাটির সঙ্গে আস্তে আস্তে মিশল প্রত্যয়, স্বপ্ন, রাগ, প্রত্যাখ্যান আর বিদ্রোহ। জন্ম নিল বব ডিলানের গান।
২০১২, হোয়াইট হাউসে। ছবি টুইটার থেকে।
ডিলানের সাঙ্গীতিক সফর বুঝতে হলে কেবল তাঁর লিরিক বা উপস্থাপনাই নয়, আমাদের হয়তো বোঝার চেষ্টা করতে হবে সেই সময়ের ধারাবাহিক পারিপার্শ্বিক বদলগুলোকে। প্রতিভার দিক দিয়ে আবশ্যিক ভাবে বিক্ষিপ্ত হলেও, সারা পৃথিবীর ঘটনাস্রোতের পাশে বসিয়ে দেখতে শুরু করলে ডিলানের গানগুলোকে সালোকসংশ্লেষের মতোই স্বতঃস্ফূর্ত, স্বাভাবিক ও জরুরি বলে বোঝা যাবে। একজন শিল্পীর দায়িত্ব যেমন সময়ের প্রতিনিধিত্ব করা, সময়েরও দায়িত্ব শিল্পীকে গড়ে নেওয়া। যে ভাবে সময় তার টুপি থেকে বার করে আনে চার্লি চ্যাপলিন বা ফ্রানৎস কাফকার মতো বিস্ফোরণকে, তেমনই সে জন্ম দেয় ডিলানকেও।
যাদের রাগ অক্ষম, যাদের প্রেম দুর্বল, যাদের জখম কাঁচা, তাদের নীরবতাকে ভাষা দিতে শুরু করলেন একজন মানুষ। কণ্ঠ তাঁর মোটেই গাইয়েসুলভ নয়, কিন্তু আজ মনে হয়, কোনও সুললিত কণ্ঠে ‘ব্লোয়িং ইন দ্য উইন্ড’ বা ‘ট্যাম্বুরিন ম্যান’ শুনতে খুব ভাল লাগত কি? ডিলানের প্রেম আছে, কিন্তু সে কখনও নতিস্বীকার করে না। তাঁর হাতের গোলাপগুচ্ছ কাঁটাসমেত উদ্যাপিত। তাঁর তুষারপাতে মিশে থাকে যুদ্ধের ছাই। তাঁর গিটার আসলে বারবার হয়ে উঠতে চায় প্রত্যাঘাতের নির্মমতা। আর এখানেই, সমসাময়িক বা পূর্বতনদের থেকে পৃথক ভাবে চিহ্নিত হন ডিলান। তাই কেবল একজন গান-লিখিয়ে নন, সারা পৃথিবীর ‘হ্যাভ নটস’-দের মিছিলের হোতা হয়ে ওঠেন তিনি। যে-প্রান্তে দাঁড়াতে কেউ সাহস করছে না, সেই প্রান্তিকতার মাস্টার হয়ে ওঠেন। তাঁকে ঘিরে একটা গোটা সাম্রাজ্য তৈরি হয়, তৈরি হয় উদ্যাপনের চূড়ান্ত প্রাতিষ্ঠানিকতা। কিন্তু এত কিছুর পরেও ‘না’-এর উচ্চারণটাই ডিলানের কলমে সব চাইতে স্পষ্ট। এইটা ধারাবাহিক ভাবে পেরে যাওয়ার জন্যে কেবল প্রতিভা নয়, একটা আলাদা কলজে লাগে। যা বহু প্রতিভাবানের থাকে না। ডিলান সেটা নিয়েই জন্মেছিলেন।
এহেন মানুষকে যখন নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়, তখন স্বাভাবিক ভাবেই পিছনে ফিরে তাকাতে ইচ্ছে করে। কারণ পিছনেই পড়ে আছে ডিলানের গোটা জীবন, যার চাইতে বড় পুরস্কার তিনি আর পাবেন না। তা সত্ত্বেও নোবেল পুরস্কার আর ডিলান— এই জুটির একখানা বিশেষ তাৎপর্য তো থেকেই যায়। এর আগেও একাধিক বার সাহিত্য নোবেল-এর জন্য ডিলানের লিরিক পৌঁছেছে নোবেল কমিটির টেবিলে। সেখানে যাঁরা বিচারক, বিশ্বসাহিত্যে সে সব লিরিক-এর সামিল হওয়ার যোগ্যতা নিয়ে তাঁদের নিশ্চয়ই সন্দেহ ছিল না? কিন্তু তবু ডিলানের গানের খাতাকে বারবার এই কারণেই খালি হাতে ফিরে আসতে হয় যে, সে-সব লেখা আদতে ‘লিরিক’। কবিতা বা উপন্যাস বা প্রবন্ধ নয়। লিরিক আদৌ সাহিত্যের উঠোনের বাসিন্দা কি না, সেই বিচার করতেই তাঁদের এতগুলো বছর লেগে গেল। এ বারের নোবেল কমিটি তাঁদের ভুল শুধরে নিয়েছেন দেখে আমরা খুশি। আমরা যারা লিরিকের দলে, যারা ‘গীতিকার’ তকমার আড়ালে নিচু নজরের খোঁচা সহ্য করি রোজ, যারা গান লেখার বন্ধু, যারা ডিলানের সমর্থক। কিন্তু ডিলান? সায়াহ্নের এই মেঘভাঙা লালচে রোদে এমন খবর তাঁকে আর প্রাপ্তির কোন শিখর উপহার দেবে? বরং বলা যায়, নোবেল কমিটিই এ বার নিজগুণে ‘ডিলান পুরস্কার’ পেলেন।
২০০৯। — এএফপি
মনে পড়ছে, ১৯১৩ সালের এক সন্ধেবেলায় এমনই খবর এসে পৌঁছেছিল শান্তিনিকেতনে। প্রাপক মানুষটি আমাদের ভাষার প্রধানতম গীতিকার। আর যে-কীর্তির জন্যে তাঁর এই সম্মানপ্রাপ্তি, তাতে কি তাঁর গানেরাও উপস্থিত ছিল না? লিরিককে তো নোবেল সম্মান জানানো হয়ে গিয়েছে সেই দিনই। ১৯৪১-এ রবীন্দ্রনাথকে হারিয়েছি আমরা। সে বছরই পেয়েছি ডিলানকে। একে কি বলব, কাকতালীয়? নাকি লিরিক্যাল ষড়যন্ত্র? সে যাই হোক, ডিলানের জন্য নোবেল আদতে ব্যতিক্রমের এক বৃত্তকেই সম্পূর্ণ করে দিয়ে গেল। আর তার সাক্ষী থাকলাম আমরা।