মানবিকতার মুখ। চিত্রসাংবাদিক এবিডি আলকাদর হাবাক। ছবি: টুইটারের সৌজন্যে
পেশাদারিত্ব বনাম মানবিকতা। দুর্ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়ে কত বার না এই বিরোধের মধ্যে পড়তে হয়েছে কত সাংবাদিক, কত চিত্রসাংবাদিককে। এক দিকে আগুনের লেলিহান শিখা একটু একটু করে এগোচ্ছে ভয়ার্ত মানুষগুলোর দিকে। উদ্ধার করতে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন এক দল মানুষ। বা পড়েননি। এক জন সাংবাদিক বা চিত্রসাংবাদিক কি উদ্ধারে ঝাঁপাবেন? না কি পেশাদারিত্বের সঙ্গে নিজের কাজটা করবেন? কী করবেন, কী করা উচিত, এ নিয়ে বিতর্কের কোনও মীমাংসা হয়নি আজও। কিন্তু সিরিয়ার চিত্রসাংবাদিক এবিডি আলকাদর হাবাক সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করেননি। ক্যামেরা ফেলে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন বোমা বিধ্বস্ত বাস থেকে শিশুদের উদ্ধার করতে। খবরের ছবিটা তোলার কথা ছিল তাঁর। তার বদলে নিজেই খবরের শিরোনামে উঠে এলেন।
গত ১৫ এপ্রিলের ঘটনা। ৭৫টি বাসের একটি কনভয় দাঁড়িয়ে ছিল উত্তর-পশ্চিম সিরিয়ার রাশিদিনের কাছে। প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের বাহিনীর হাতে থাকা আলেপ্পোয় ঢোকার অপেক্ষায়। হঠাৎ সেই বাসের সারিতে ঘটল বিস্ফোরণ। নিহত হলেন অন্তত ১০০ জন। আহত ৫৫। আর এখানেই পেশাগত ‘মুখোশ’টা পাশে খুলে রেখে চিত্রসাংবাদিক এবিডি আলকাদর হাবাক ঝাঁপিয়ে পড়লেন উদ্ধারকাজে। তখন কোথায় তাঁর সাধের দামি ক্যামেরা, কোথায় ব্রেকিং নিউজের তৎপরতা। ভুলে গেলেন পেশাদারিত্ব। দুর্ঘটনাস্থল থেকে কোলে করে তুলে নিয়ে এলেন ছোট্ট ছেলেটাকে। কিন্তু ততক্ষণে বিষের ধোঁয়ায় ঢেকে গিয়েছে অন্য একটি শিশুর কাতর মুখ। পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে এলেন তাঁকেও। কিন্তু বাঁচাতে পারলেন না প্রথম শিশুটিকে। যন্ত্রণায় বুক ফাটা কান্নায় ভেঙে পড়লেন আলকাদর। তাঁর সেই ছবি ‘মানবিকতার মুখ’ হয়ে ভাইরাল হল সোশ্যাল মিডিয়ায়।
আরও পড়ুন: অরুণাচলের ৬ এলাকার নতুন নামকরণ করে প্ররোচনার রাস্তায় চিন
অসহায় আলকাদর। ছবি: টুইটারের সৌজন্যে
ঠিক কী ঘটেছিল?
সিরিয়ার আসাদ সরকার ও বিদ্রোহীদের মধ্যে বোঝাপড়া হয়েছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত সাধারণ নাগরিকদের সরিয়ে নেওয়া হবে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে দূরে কোনও আশ্রয়ে। সেই আশায় বাসে চড়ে আলেপ্পোর কাছে রাশিদিনে জড়ো হয়েছিলেন কেফ্রায়া ও আল-ফোয়ার বাসিন্দারা। ওই বাসগুলিতে চাপিয়েই সরানো হচ্ছিল আপাতত বিদ্রোহীদের দখলে থাকা দু’টি গ্রামের শিয়া মতাবলম্বী গ্রামবাসীদের। সরকারপন্থীদের দখলে থাকা এলাকায় বিদ্রোহী এবং বিদ্রোহীদের এলাকায় থাকা সরকারপন্থী মানুষজনদের স্থানান্তরের কাজ শুরু হয়েছিল। আলেপ্পোয় ঢোকার মুখে শহরের অদূরে দাঁড়িয়েছিল ওই কনভয়। সেই সময়ই বাস থেকে নেমে এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করছিলেন যাত্রীরা।
কাছেই ছিল চিপসের একটি দোকান। সেখানেই পরিবারের সঙ্গে দাঁড়িয়েছিল ছোট্ট ছেলেটি। হঠাৎই তীব্র শব্দে বিস্ফোরণ। পাশেই ক্যামেরা নিয়ে নিজের কাজ করছিলেন চিত্র সাংবাদিক এবিডি আলকাদর হাবাক। সঙ্গে ছিলেন তাঁর সহকর্মীরাও। সকলেই খবর সংগ্রহে, ছবি তোলায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন। কিন্তু মানবিকতার দায় উপেক্ষা করতে পারেননি আলকাদের। মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নেন ঝাঁপিয়ে পড়ার। ততক্ষণে আশপাশের পরিবেশটা যেন নরক। বোমা, রক্ত, শিশুদের চিৎকার, মায়ের বুক ফাটা কান্না...।
শেষ চেষ্টা করলেন বেঁচে যাওয়া মানুষগুলোকে উদ্ধার করার। পুরোটা সফল হলেন না। যে ছোট ছেলেটিকে নরকযন্ত্রণা থেকে উদ্ধার করলেন, বিস্ফোরণের ভয়াবহতার সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে ততক্ষণে নিষ্প্রাণ সেই খুদে শরীর। তাকে নামিয়ে রেখে ছুটে গেলেন তালগোল পাকিয়ে যাওয়া বাসের মধ্যে আটকে পড়া অন্য একটি শিশুর দিকে।
‘‘ও আমার হাত ধরল। আমার দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। তখনও ধুকপুক করছিল ও। আমি অ্যাম্বুল্যান্স অবধি পৌঁছে দিয়েছিলাম ওকে’’— সংবাদ সংস্থাকে এমনই জানালেন আলকাদর।
কিন্তু প্রথম শিশুটির করুণ পরিনতির কথা ভুলতে পারেননি আলকাদের। শিশুর মৃতদেহ সামনে রেখে কান্নায় ভেঙে পড়লেন তিনি। তাঁর বন্ধু-সহকর্মীর ক্যামেরায় ধরা থাকল সেই ছবি।