আবেগে বুজে আসছে গলা। মঞ্চের উপর সাজানো বক্তৃতার বয়ানও তত ক্ষণে এলোমেলো। বদলে শুধুই আর্তি এক বৃদ্ধের বন্ধ হোক রক্তপাত। শান্তি আসুক বিশ্বে।
রবিবারের দুপুর। ভ্যাটিকানের সেন্ট পিটার্স স্কোয়ার। আর মাইকের পিছনে পোপ ফ্রান্সিস! প্রতি রবিবারেই ভ্যাটিকানের বারান্দায় এসে দাঁড়ান পোপ। কথা বলেন ইতিহাস, সমাজ, ধর্ম, নানা বিষয়ে।
ভ্যাটিকানের সেন্ট পিটার্স স্কোয়ারে
পোপ । রবিবার। ছবি: এএফপি
কিন্তু আজকের দিনটা আলাদা। ঐতিহাসিক। একশো বছর আগে, এর পরের দিন, অর্থাৎ ২৮ জুলাই, শুরু হয়েছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। বিশ্ব ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণ সেটি। সেন্ট পিটার্স স্কোয়ারে সমবেত সকলে জানতেন, আজ সেই বাঁক বদলের গল্পই বলবেন পোপ। কিন্তু চিত্রনাট্য বদলে ফেললেন ফ্রান্সিস নিজেই। লিখিত বয়ানের বাইরে বেরিয়ে এলেন। ইতিহাস ফেলে পৌঁছে গেলেন আজকের রক্তস্নাত পৃথিবীতে। গাজা-ইরাক-ইউক্রেনে। গলার মধ্যে জমে থাকা কান্না বেরিয়ে এল আবেদন হয়ে। বিশ্বশান্তির বার্তা দিয়ে পোপের আর্তি, “দয়া করে থামুন। সর্বান্তঃকরণে বলছি, এ বার থামার সময় হয়েছে। আর না। দয়া করুন।”
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ মারা গিয়েছিলেন অন্তত দেড় কোটি মানুষ। কিন্তু ইতিহাসের পাতা থেকে সেই পরিসংখ্যান তুলে আনেননি পোপ। অতীত নয়, বর্তমান নিয়েই যে তিনি বেশি ভাবিত, ব্যথিত, তা বুঝতে এতটুকুও অসুবিধে হয় না। তিনি বলে চললেন, “দয়া করে যুদ্ধ বন্ধ করুন আপনারা। সেই সব শিশুর কথা ভাবুন, যারা আর কোনও দিন ফিরে আসবে না। সারা শরীরে ক্ষত নিয়ে যারা আজ হাসতে ভুলে গিয়েছে। যুদ্ধের আঘাতে হঠাৎই যারা অনাথ। বাধ্য হয়েই যুদ্ধক্ষেত্র থেকে যারা খেলনা কুড়িয়ে আনছে, রোজ।” ইজরায়েলি সেনা ও প্যালেস্তাইনি জঙ্গিগোষ্ঠী হামাসের লাগাতার সংঘর্ষ নিয়ে সরাসরি কোনও মন্তব্য না করলেও, পোপের এই আর্তি মনে করিয়ে দিল গাজা ভূখণ্ডে ক্রমশ বেড়ে চলা মৃত্যুমিছিলের কথাই। ইতিমধ্যেই সেখানে নিহতের সংখ্যা হাজার ছাড়িয়েছে। প্যালেস্তাইনি স্বাস্থ্য মন্ত্রকের অভিযোগ, ইজরায়েলি সেনা হামলায় মারা গিয়েছে দু’শোরও বেশি শিশু। জখম অন্তত কয়েক হাজার।
চোখে জল। পোপ বলে চলেন, “আলোয় মোড়া একটা সুস্থ জীবন, আশায় ভরপুর সুন্দর একটা ভবিষ্যৎ থেকে এ ভাবে পিছিয়ে আসার কি কোনও মানে হয়!” পোপ নির্বাচিত হওয়ার দিনটি থেকেই চলনে-বলনে পূর্বসূরিদের থেকে অনেকটাই আলাদা ফ্রান্সিস। উদারপন্থী, কখনও-সখনও বৈপ্লবিকও বটে। গত বছর ১৩ মার্চ যখন পোপ নির্বাচিত হন তিনি, আর্থিক দুর্নীতি ও যৌন কেলেঙ্কারিতে তখন জর্জরিত ভ্যাটিকান। মাত্র দেড় বছরে সেই ভ্যাটিকানকে কেচ্ছা-কেলেঙ্কারির আবহ থেকে ‘উদ্ধার’ করেন। ব্যতিক্রমী ফ্রান্সিসের নাম হয়, ‘রক স্টার পোপ’।
তিনি যে আলাদা, তা বুঝিয়ে দিল তাঁর আজকের ইতিহাস-কথনও।