বিপুল ভোটে জিতল ‘হ্যাঁ’, আর কোনও সবিতা নয়

আজ দেওয়ালে আঁকা সবিতার মুখটার সামনে ফুলের স্তূপ। পাশে অসংখ্য কাগজের টুকরোয় লেখা ‘ইয়েস’। দীর্ঘ আন্দোলনের পরে সংবিধানের অষ্টম সংশোধনী বাতিল করার দাবিতে গণভোটের আয়োজন হয়েছিল গত কাল। বিপুল ভোটে জিতলেন হ্যাঁ-পন্থীরা।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

লন্ডন শেষ আপডেট: ২৭ মে ২০১৮ ০২:৪৪
Share:

শ্রদ্ধা: সবিতার ছবির সামনে ফুল দিচ্ছেন আইরিশ মা-ছেলে। শনিবার। ছবি: এএফপি।

ডাবলিনের জর্জ বার্নার্ড শ পাবের দেওয়ালে আঁকা মুখটা যেন অনেক কিছু বলে দেয়। মনে করিয়ে দেয় ছ’বছর আগের কথা। গর্ভস্থ সন্তান বাঁচবে না জেনেও মরণাপন্ন ভারতীয় চিকিৎসক সবিতা হলপ্পনবারের গর্ভপাত করাতে রাজি হননি ডাক্তাররা। কারণ, ক্যাথলিক দেশ আয়ারল্যান্ডে গর্ভপাত শাস্তিযোগ্য অপরাধ। মারা গিয়েছিলেন সবিতা।

Advertisement

আজ দেওয়ালে আঁকা সবিতার মুখটার সামনে ফুলের স্তূপ। পাশে অসংখ্য কাগজের টুকরোয় লেখা ‘ইয়েস’। দীর্ঘ আন্দোলনের পরে সংবিধানের অষ্টম সংশোধনী বাতিল করার দাবিতে গণভোটের আয়োজন হয়েছিল গত কাল। বিপুল ভোটে জিতলেন হ্যাঁ-পন্থীরা। তাঁরা পেলেন ৬৬.৪০ শতাংশ ভোট আর ‘না’-পন্থীরা পেলেন মাত্র ৩৩.৬০ শতাংশ।

গত তিন বছরে একের পর এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ করেছে আয়ারল্যান্ড। দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত করেছে এক সমকামী পুরুষকে। সমকামী বিবাহকে আইনি স্বীকৃতি দেওয়ার দাবিতে গণভোট করেছে। তবে নির্দিষ্ট করে এই গর্ভপাত বিরোধী আইন বদলানোর দাবি ছিল সবচেয়ে জোরদার। বরাবরই পরিবর্তনপন্থী আয়ারল্যান্ডের ভারতীয় বংশোদ্ভূত প্রধানমন্ত্রী লিও ভারাডকর। বলেন, ‘‘আজ যে ঘটনার সাক্ষী হলাম, তাতে এটা স্পষ্ট, গত ১০-২০ বছরে নিশ্চুপে একটা বিদ্রোহ ঘটে গিয়েছে আয়ারল্যান্ডে। তারই মিশ্র প্রতিফলন এই গণভোটের ফলাফল।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘মানুষ জবাব দিয়েছে: আধুনিক দেশের জন্য আমাদের আধুনিক সংবিধান প্রয়োজন। মহিলাদের প্রতি ভরসা রাখা উচিত। তাঁদের যথেষ্ট সম্মান জানিয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করা উচিত। তাঁরা যাতে নিজেদের স্বাস্থ্য নিয়েও যত্নশীল হতে পারেন, সেটাও দেখা উচিত আমাদের।’’ সমাজবিদদের মতে, দীর্ঘদিন ধরে ক্যাথলিক গির্জাগুলির প্রতিপত্তি, ক্ষমতাবলে মুখ বুজে ছিল দেশটা। কিন্তু একের পর এক দুর্নীতি, কেচ্ছা, কেলেঙ্কারিতে জড়ানোয় গির্জার প্রতি মানুষের বিশ্বাস ক্রমশ কমেছে। ফলে মানুষ নিজেদের মতো করে বিচার করতে শুরু করেছে। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে সরব হচ্ছে। উল্লেখ্য, চাপের মুখে গোটা গণভোট পর্বে এক বারের জন্যেও মুখ খোলেনি গির্জা। বরং আড়ালেই থেকেছে।

Advertisement

১৯৮৩ সালের অষ্টম সাংবিধানিক সংশোধনী অনুযায়ী মা ও গর্ভস্থ শিশু, দু’জনেরই বাঁচার সমান অধিকার রয়েছে। তাই কেউ গর্ভপাত করালে ১৪ বছর পর্যন্ত জেল ও জরিমানা হতে পারে। এর ফলে গর্ভস্থ শিশুর ভয়াবহ অসুস্থতা বা অস্বাভাবিকতা কিংবা অন্তঃসত্ত্বা মহিলার মৃত্যুর আশঙ্কা থাকলেও গর্ভপাতের অনুমতি মেলে না এ দেশে। এমনকি ধর্ষণের কারণে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়লেও গর্ভপাত করতে দেওয়া হয় না আয়ারল্যান্ডে। ২০১২ সালের ২১ অক্টোবর গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় ‘ইউনিভার্সিটি হসপিটাল গলওয়ে’তে ভর্তি হন সবিতা। ১৭ সপ্তাহের অন্তঃসত্ত্বা সবিতার প্রাথমিক পরীক্ষার পরেই চিকিৎসকেরা জানিয়ে দিয়েছিলেন গর্ভস্থ ভ্রূণের বাঁচার সম্ভাবনা নেই। কিন্তু তখনও ভ্রূণের হৃৎস্পন্দন পাওয়া যাচ্ছিল। চিকিৎসকেরা জানান, স্বাভাবিক ভাবেই গর্ভপাত হওয়ার অপেক্ষা করা হবে। সবিতা নিজে চিকিৎসক। বারবার অনুরোধ করেছিলেন, ওষুধের সাহায্যে গর্ভপাত করানো হোক। কারণ ভ্রূণকে ঘিরে রাখা পর্দা ফেটে সংক্রমণ হওয়ার আশঙ্কা প্রবল। কিন্তু চিকিৎসকেরা জানিয়ে দেন, আইরিশ আইনে তাঁদের হাত-পা বাঁধা। ২৪ অক্টোবর স্বাভাবিক ভাবেই গর্ভপাত হয়। কিন্তু তত ক্ষণে সেপসিস হয়ে গিয়েছে। সবিতাকে আইসিইউয়ে ভর্তি করানো হলেও বাঁচানো যায়নি। গণভোটের রায়ের পরে এ দিন ডাবলিনের এক চিকিৎসকও বলেন, ‘‘এ বার নির্ভয়ে নিজের দায়িত্ব পালন করতে পারব। জেলে যাওয়ার ভয় তাড়া করবে না।’’

স্ত্রীর মৃত্যুর পরে প্রবীণ হলপ্পনবার বলেছিলেন, ‘‘একুশ শতকেও এমন আইন হয়!’’ ১৯৮৩-র সেই আইন ২০১৮তে বদলাবে কি না, তা জানতে আরও অপেক্ষা বাকি। গণভোটে হ্যাঁ-পন্থীরা জিতলেও পার্লামেন্টের উচ্চ ও নিম্ন কক্ষ ছাড়পত্র না দেওয়া পর্যন্ত বেআইনিই থাকবে গর্ভপাত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন