এ বারের মাতৃমূর্তি।—নিজস্ব চিত্র।
হৈ হৈ করে এসে পড়েছে শীত। হাড় কাঁপানোই বটে। দিনের বেলা মাইনাস তিন–চার ডিগ্রি ঠান্ডা অনেক দিন দেখেনি লন্ডন। ভারী ভারী কোট-টুপি-মোজায় ধোপদুরস্ত বাঙালির একদম ল্যাজেগোবরে অবস্থা। সকালবেলা গাড়ি পরিষ্কার করার জন্য দশ-পনেরো মিনিট চলে যাচ্ছে! বরফ পরিষ্কার করতে করতে হাত জমে প্রায় কালশিটে।
ক্রিসমাসের ডেকরেশন নামতে না নামতেই এসে গেল বসন্ত পঞ্চমী! অন্য বছর এই সময় মাথা তুলে উঁকি মারে ড্যাফোডিল, নার্সিসাস, কুচি কুচি সাদা সাদা স্নো ড্রপ ফুল। এ বার কোথায় কী? কিন্তু, তাই বলে সরস্বতী পুজো তো আর আটকে থাকবে না। তিনি এ বার ‘রিইনকার্নেশন’ করে সোজা কুমোরটুলি থেকে হাজির ক্রয়ডন বেঙ্গলি কানেকশনের মঞ্চে। স্যুটকেসবন্দি পাটের দড়ির বাদামি সরস্বতী ভিসার কড়াক্কড়ি পেরিয়ে দিব্বি চলে এসেছিলেন টেমসের পারে। বছর পাঁচেক পর যখন সরস্বতীর আবার মেক আপের প্রয়োজন পড়েছে ঠিক তখনই ছুমন্তরে হয়ে গেলেন একেবারে শোলার কাজের ধবধবে শ্বেতশুভ্রা বীণাপাণি।
সরস্বতী পুজো নিয়ে কচিকাঁচাদের আনন্দ দেখার মতো। প্রতি বারের মতো এ বারেও নাটকে মেতে উঠেছে তারা। এটাই তাদের নিজেকে চেনার সময়। কখনও কাবুলিওলা, কখনও টুনটুনির গল্প, কখনও বা সুকুমার রায়। আগের বারের থিম ছিল সাতভাইচম্পা। এ ভাবেই দ্বিতীয় প্রজন্ম চেনে নিজেদের, চেনে বাংলা গল্প, বাংলায় হাসে, ভালবাসে, নাচে, গায়। কিচিরমিচির করে রিহার্সাল করে প্রতি সপ্তাহান্তে। হোমওয়ার্কের খাতা গুটিয়ে রেখে আনন্দমেলার সময় এটা। সত্যি বলতে ওদের জন্যেই না এত কিছুর আয়োজন।
এ বছর তাদের দেওয়া হয়েছে অন্য রকম গল্প। গল্পের শুরু বিংশ শতকের শুরুর দিকের কলকাতায়। হাটখোলা দত্তবাড়ির মেয়ে লাবণ্যময়ী দত্ত ছিলেন নিবেদিতা স্কুলের প্রথম দিকের ছাত্রী। সিস্টার ক্রিস্টিনের কোলে চড়ে স্কুলে আসতেন। তখনকার দিনে মেয়েদের স্কুলে যাওয়ার কোনও অনুমতি ছিল না, নিবেদিতা এসে ভিক্ষে করে চেয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন লাবণ্যের বোনদের তাঁর বাবা ভূপেন্দ্রনাথ দত্তের কাছ থেকে। নিজের স্কুলের ছাত্রী হিসেবে। সেই গল্পে একে একে এসেছে ক্রিস্টিন, নিবেদিতা, বিবেকানন্দ এবং আরও অনেকে। কলকাতায় স্কুল শুরুর অনেক আগের গল্প, মার্গারেট থেকে নিবেদিতা হওয়ার গল্প। ইসাবেলা মার্গেসনের সেন্ট জর্জেস ড্রাইভের বাড়িতে স্বামীজির সঙ্গে প্রথম দেখা হওয়ার কথা। ছাত্রীদের দিয়ে প্রথম ভারতের পতাকা আঁকিয়েছিলেন যে নিবেদিতা। লাল-হলুদ সেই পতাকার মধ্যখানে ছিল বজ্রচিহ্ন। সে কথা অনেকেরই অজানা ছিল, নাটকের মধ্যে দিয়ে জানল সকলে, শুধু বাচ্চারা নয়, জানল তাদের মা-বাবাও।
সরস্বতী পুজোয় বাচ্চাদের প্রতি বার একটি করে ছবি দিয়ে দেওয়া হয়। তারা সেটা রঙ করে আনে। এ বারে সেই ছবি হল বজ্রচিহ্ন দেওয়া পতাকা। কচিকাঁচারা মহা উৎসাহে রং করে এঁকে নিয়ে এল সেই প্রথম পতাকা। এ ভাবেই প্রথম ভারত-পতাকার গল্প জানল পাঁচ থেকে পনেরো বছরের লন্ডনের দ্বিতীয় প্রজন্মের বাঙালিরা। মেধাবী, চলতি কথায় স্ট্রিট-ওয়াইজ, আধুনিক প্রযুক্তি তাদের হাতের মুঠোয়, তবু তারা কিন্তু শ্রদ্ধাশীল ভারতের ইতিহাসের প্রতি। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য দুই শব্দের উপর সমান ভাবে আগ্রহী ক্রয়ডনের এই দ্বিতীয় প্রজন্ম।
নাটকে এক এক জন দেবশিশু সমবেত কণ্ঠে আগের বার গেয়েছিল ‘আই হ্যাভ এ ড্রিম...’ এ বারে তারা গেয়েছে বন্দেমাতরম। ওল্ডপ্যালেস স্কুলের ছাদ ফুঁড়ে সেই আওয়াজ ছড়িয়ে পড়ে দিকে দিকে যেন। পুরো গানের কঠিন তৎসম শব্দগুলি শুদ্ধতায় উচ্চারিত হয় শিশুকণ্ঠে। ‘কোটি কোটি কণ্ঠ কলকল নিনাদ করালে’ —গায়ে কাঁটা দেয় সভাশুদ্ধ জনতার। নাটকের মূল চরিত্র লাবণ্যদের স্কুলেও তো এই গানই গাওয়া হত।
ক্রয়ডন বেঙ্গলি কানেকশন নিবেদিতার উইম্বলডনের বাড়িতে নীল ফলক বসিয়ে চিহ্নিত করার জন্যে আবেদন করেছিল ইংলিশ হেরিটেজের কাছে। সঙ্গে ছিলেন আরও কিছু মানুষ। সেই আবেদন অবশেষে মনোনীত হয়েছে। শুধুমাত্র কয়েকটি অফিসিয়াল স্টেপ বাকি আছে। সম্ভবত আগামী ২৪ অক্টোবর উইম্বলডনের ওয়ার্পল রোডের বাড়িতে ব্রিটিশ হেরিটেজের নীল ফলক বসবে।
ক্রয়ডন বেঙ্গলি কানেকশনের শিশুরা এই ঘটনার সূচনা করে দিল লন্ডনের হিমশীতল সরস্বতী পুজোর এই দিনে। বাঙালির ভ্যালেন্টাইন, জোড়া ইলিশ, গোটা সেদ্ধ, বই পুজো, সব কিছুই রইল। খিচুড়ি বাঁধাকপি কুলের চাটনি তাও বাদ গেল না। সঙ্গে রইলেন নিবেদিতাও। তাই এ বারের বসন্ত পঞ্চমী হয়ে উঠল নিবেদিতা পঞ্চমী।