ফতোয়াকে গোল, প্রকাশ্যে খেলা দেখলেন মেয়েরা

হবু বরের হাতটা শক্ত ধরে করে রেখেছেন হিজাব পরা তরুণী। দু’টি চোখ টিভির পর্দায়। ম্যানিকিওর করা নখটা উত্তেজনায় কামড়ে খেতে শুরু করলেন আর এক জন। তাঁর দু’পাশে বসে দুই পুরুষ বন্ধু। সেকেন্ডে সেকেন্ডে পাল্টে যাচ্ছে ছবি। এই বুঝি গো-ও-ও-ল! নাহ্ ফস্কে গেল। দু’হাতে মুখ ঢেকে চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠলেন অন্য তরুণী। আশপাশে চিৎকার করছেন সবাই।

Advertisement

সংবাদ সংস্থা

তেহরান শেষ আপডেট: ২৪ জুন ২০১৪ ০৪:১৫
Share:

ইরান-আর্জেন্তিনা ম্যাচের দিন তেহরানে রাস্তাতেই আনন্দে মাততে দেখা গিয়েছে মেয়েদের। —ফাইল চিত্র।

হবু বরের হাতটা শক্ত ধরে করে রেখেছেন হিজাব পরা তরুণী। দু’টি চোখ টিভির পর্দায়।

Advertisement

ম্যানিকিওর করা নখটা উত্তেজনায় কামড়ে খেতে শুরু করলেন আর এক জন। তাঁর দু’পাশে বসে দুই পুরুষ বন্ধু।

সেকেন্ডে সেকেন্ডে পাল্টে যাচ্ছে ছবি। এই বুঝি গো-ও-ও-ল! নাহ্ ফস্কে গেল। দু’হাতে মুখ ঢেকে চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠলেন অন্য তরুণী। আশপাশে চিৎকার করছেন সবাই।

Advertisement

ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে চলেছে। পায়ে পায়ে এগোচ্ছেন দেশের ফুটবলাররা। কী হয়-কী হয় উত্তেজনায় ছটফট করছেন তরুণী। ইরান বনাম আর্জেন্তিনার ম্যাচ এ ভাবেই চেটেপুটে উপভোগ করছিলেন তিনি। তা-ও আবার নিজের দেশের মাটিতে। তবে নিজের ঘরের চার দেওয়ালের মধ্যে নয়। প্রকাশ্যে আরও অনেকের সঙ্গে একটি কফি শপে। গত সপ্তাহান্তের ওই ম্যাচ দেখতে দেখতে তাঁর মতো উৎসাহী অনেক মেয়েকেই দেখা গিয়েছে দেশের হয়ে গলা ফাটাতে। বিশ্বকাপ সম্প্রচারের নিষেধাজ্ঞা উড়িয়ে এ বার ইরানের বেশ কিছু রেস্তোরাঁ এগিয়ে এসেছে মেয়েদের জন্য। জায়ান্ট স্ক্রিনে দেখানো হচ্ছে খেলা। আর কট্টরপন্থীদের সব ফতোয়াকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে মহিলা-পুরুষ পাশাপাশি বসে ম্যাচ দেখেছেন তারিয়ে তারিয়ে।

শেষমেশ নিজের দেশ হেরে গেলেও খুব আশাহত হননি মহিলা-ভক্তকুল। কারণ তাঁরা মানছেন, ইরান অসম্ভব ভাল খেলেছে। আর তাই ম্যাচ শেষ হতেই রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে গাড়িতে হুল্লোড় করতে রাস্তায় নামেন অনেকে। গাড়ির ভিতর থেকে হাত নেড়ে, চিৎকার করতে দেখা যায় তাঁদের। নেগার ভালায়ি নামে এক জন যেমন বললেন, “দারুণ ব্যাপার। এমন তো সব সময় হয় না। এ রকম যদি বেশি করে হয়, তা হলে ভাল হয়।” ক্যাফেতে হাজির রোয়া মার্জবাহানের মন্তব্য, “এক সঙ্গে অনেকের মধ্যে বসে খেলা দেখার মজাই আলাদা। টান টান উত্তেজনা থাকে।”

১৯৭৯ সালে আয়াতোল্লা খোমেইনির নেতৃত্বে বিপ্লবের পরে ইরানে খেলাধুলোয় অংশগ্রহণ বা শুধু দেখার আনন্দ থেকে অনেকটাই বঞ্চিত হতে শুরু করেন মেয়েরা। নারী-পুরুষ একসঙ্গে খেলা উপভোগ করছে এটা ভাবাই যেত না। ইসলাম বিরোধী তকমা দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয় এই সব। কিছুটা উদার প্রেসিডেন্ট মহম্মদ খাতামির শাসনের সময়ে মেয়েরা অল্প সময়ের জন্য তবু ভলিবল ম্যাচ খেলার সুযোগ পেয়েছিল। কিন্তু ২০০৫ সালে মহম্মদ আহমদিনেজাদ প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরেই ছবিটা বদলে যায়। চাপিয়ে দেওয়া হয় নিষেধ। ফলে ’৭৯ সাল থেকে ৩৫ বছর ধরে ইরানে সব চেয়ে জনপ্রিয় খেলা ফুটবল প্রকাশ্যে দেখতে পেতেন কেবল পুরুষরাই।

এ বারও প্রশাসনের তরফে সে রকমই নির্দেশ ছিল। রেস্তোরাঁর তরফে এক মহিলা জানালেন, “আমাদের বলা হয়েছিল টিভি চালাবেন না। সমস্যা হতে পারে।” তেহরানের রাস্তায় বিশ্বকাপের প্রচারে যত বিলবোর্ড রয়েছে, তাতে কোথাও মহিলার ছবি খুঁজে পাওয়া যাবে না। এমনকী ম্যাচ টিভিতে সম্প্রচারের সময়েও সরকারি নির্দেশমতো কিছু দৃশ্য ছেঁটে দেওয়ার জন্য কয়েক সেকেন্ড দেরি করা হয় সেখানে। মাঠে হাজির মহিলা-ভক্তদের উল্লাসের ছবি দেশের মেয়েদের দেখাতে চায় না সরকার।

কিন্তু দেশের মেয়েরা সে সবের পরোয়া করছেন না সব সময়। শনিবারের ম্যাচই তার প্রমাণ। তা ছাড়াও এই মাসের গোড়াতেই তেহরানে পুরুষদের ভলিবল ম্যাচে ব্রাজিলের সমর্থকদের ছদ্মবেশে ঢুকে পড়েছিলেন বেশ কয়েক জন তরুণী! আর যাঁরা দেখতে পাননি, মাঠের বাইরে বিক্ষোভ দেখিয়েছেন। সরকারি সংবাদমাধ্যমেই প্রচারিত হয়েছে সেই খবর। নেগার ফের বললেন, “আমাদেরও অধিকার আছে। কেন ম্যাচ দেখতে যাব না আমরা?” রোয়ার মন্তব্য, “ওরা তো আমাদের অধিকার ছিনিয়ে নিচ্ছে। নিজের দেশের খেলা কেন দেখতে দেওয়া হবে না আমাদের?”

খেলা দেখার ক্ষেত্রে দেশের মেয়েরা সমানাধিকার চান, জানেন ইরানের মহিলা ভাইস প্রেসিডেন্ট শাহিন্দোখ্ত মোলাভার্দি। তাই ভলিবল ম্যাচ দেখায় মহিলাদের উপরে নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে খোঁজ নিচ্ছেন তিনি। নরমপন্থী প্রেসিডেন্ট হাসান রৌহানির সবুজ সঙ্কেতের অপেক্ষায় নেগার-রোয়ারা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন