৫৩ ঘণ্টা হেঁটে মুক্তির পথে ইয়েজ়িদি তরুণী

কিশোরী ফরিয়াল হয়তো তখনও জানতেন না রুক্ষ পাথুরে রাস্তা দিয়ে এক নাগাড়ে ৫৩ ঘণ্টা হাঁটতে হলে ঠিক কতটা কষ্ট হয়। 

Advertisement

সংবাদ সংস্থা

আমুদা (সিরিয়া) শেষ আপডেট: ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০২:২৭
Share:

জঙ্গি কবল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর ঘরে ফেরা। ছবি: সংগৃহীত

ডান হাতের পিছনে উল্কিটা আঁকাতে পাঁচ দিন লেগেছিল। ব্যথাটা অবশ্য থেকে গিয়েছিল আরও কয়েক দিন। হাশিম। স্বামীর নামের সেই ট্যাটু করাতে গিয়ে ব্যথায় তেমন আমল দেননি বটে তবে মনে রেখেছিলেন বেশ কিছু দিন। কিশোরী ফরিয়াল হয়তো তখনও জানতেন না রুক্ষ পাথুরে রাস্তা দিয়ে এক নাগাড়ে ৫৩ ঘণ্টা হাঁটতে হলে ঠিক কতটা কষ্ট হয়।

Advertisement

২০১৪ সালের অগস্ট। ইরাকের বিভিন্ন অংশ তখন কব্জা করতে শুরু করেছে আইএস। চারিদিকে উড়ছে ইসলামি জঙ্গি সংগঠনের পতাকা। ছেলে আর স্বামীকে নিয়ে ইরাকের তেল বানাতের এক গ্রামে থাকতেন এখন সদ্য কুড়ি পেরোনো এই ইয়েজ়িদি কন্যা। ছাপোষা সংসার। আইএস জঙ্গিরা তাঁদের গ্রামে

ঢুকে পড়েছে শুনে এক দিন স্বামী-সন্তান-সহ পরিবারের দশ জন মিলে একটা গাড়ি করে পালাতে গিয়েছিলেন তাঁরা। কিন্তু বেশি দূর এগোতে পারেননি। বাকিদের মেরে ফরিয়াল আর তাঁর ছেলেকে ধরে নিয়ে নিয়ে যায় জঙ্গিরা। যৌনদাসী বানানো হয় তাঁকে।

Advertisement

পাঁচ বার চেষ্টা করেছিলেন পালাতে। পারেননি। সুযোগ আসে গত বছর। যখন ইরাকের একের পর এক আইএস ঘাঁটি গুঁড়িয়ে দেয় মার্কিন নেতৃত্বাধীন কুর্দিশ বাহিনী।

গত সপ্তাহে উত্তর সিরিয়ার আমুদায় কুর্দিশ বাহিনী ফরিয়ালকে উদ্ধার করে। তাঁকে বাড়ি ফেরত পাঠানোর তোড়জোড় শুরু হয়েছে। কিন্তু তার আগে সাংবাদিক সম্মেলন করা হয় তাঁকে নিয়ে। ছোট্ট হোশিয়ারকে কোলে বসিয়েই বছরের পর বছর ধরে তাঁদের উপর হওয়া নির্মম অত্যাচারের কাহিনি শুনিয়েছেন ফরিয়াল। জানিয়েছেন, নির্যাতনের হাত থেকে রেহাই পেত না তাঁর একরত্তি ছেলেও। কখনও গরম প্লেটে তার কচি হাত ঘষে দেওয়া হত, কখনও প্রয়োজনের সময়ে তাকে শৌচাগারে যেতে দেওয়া হত না। অত্যাচরিত হতে হতে সেই ছেলে ঠিক করে কথা বলতে পারে না এখন। সাংবাদিক সম্মেলনের ঘরে মায়ের কোলে বসেও তার দু’চোখ শুধু ঘুরেছে কোথাও কেউ আবার তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে কি না, সেই আতঙ্কে।

ছ’বার হাত বদল হওয়া ফরিয়াল মনে রেখেছেন তাঁর সব চেয়ে অত্যাচারী মালিককে। আবু কাট্টাব। মা-ছেলে কাউকে রেয়াত করত না সেই জঙ্গি। ফরিয়ালের গালে তার পাঁচ আঙুলের দাগ থেকে গিয়েছিল বহু দিন। কিন্তু ফরিয়াল জানিয়েছেন, ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে সব মেনে নিতেন তিনি। কারণ, প্রতিবাদ করলেই ছেলের উপরে চলত অকথ্য নির্যাতন। কোনও কোনও ইয়েজ়িদি মায়ের থেকে সন্তানদের কেড়েও নিত তারা। হোশিয়ারকে কাছছাড়া করবেন না বলে মুখ ফুটে কোনও শব্দ উচ্চারণ করতেন না ফরিয়াল।

গত জানুয়ারিতে কুর্দিশ অভিযানের শেষ দিকে কোণঠাসা আইএস জঙ্গিরা পালাতে পালাতে ইরাকের বাঘোজ়ে আশ্রয় নেয়। ফরিয়াল জানিয়েছেন, খাবার-ওষুধের রসদ কমতে থাকায় আইএস জঙ্গিরা তখন প্রাণ বাঁচাতে মরিয়া। নিজে সারাদিন না খেয়ে সে সময়ে একখানা রুটি ছেলেকে খাইয়ে রাখতেন তিনি। মার্কিন বাহিনীর চোখে ধুলো দেওয়ার জন্য শেষমেশ ফরিয়াল আর তাঁর সন্তানকেই হাতিয়ার করে জঙ্গিরা। জানায়, ইয়েজ়িদি এই মা-ছেলেকে নিরাপদ স্থানে পৌঁছে দিতে চায় তারা। কিন্তু এক উজবেক পরিবার তাঁদের সেখান থেকে উদ্ধার করে নিয়ে পালায়।

দু’দিনেরও বেশি সময় ধরে টানা হেঁটে অবশেষে মুক্তি পেয়েছেন ফরিয়াল। পাঁচ বছরের ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে পালাতে গিয়ে রাস্তার পাশে পড়ে থাকতে দেখেছেন মৃতদেহের স্তূপ। তার পাশে বসেই একটু জিরিয়ে নিতে হয়েছে কখনও। কিন্তু পরিবারের কাছে ফেরার আনন্দে সেই আতঙ্কও গায়ে মাখেননি। ছেলেকেও বুঝিয়েছেন, ‘দাদু-দিদার কাছে ফিরছি আমরা। চার বছর পরে। ঈশ্বরের কাছে এর থেকে বেশি আর কী ই বা চাওয়ার থাকতে পারে’!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন