পনেরো বছর ধরে শুধু চিপ্স খেয়েই বড় হয়েছেন ব্রিটেনের কর্নওয়ালের বছর কুড়ির তরুণী হানা লিট্ল। অবশেষে তাকে পিৎজা খাওয়াতে সক্ষম হলেন লন্ডনের এক মনোবিদ। আর এ কাজের মাধ্যম হিসেবে তিনি বেছেছেন সম্মোহনকে।
মনোবিদদের মতে, ‘সিলেকটিভ ইটিং ডিসঅর্ডার’ (এসইডি)-এর শিকার হানা। কোনও খাবার দেখলেই আতঙ্কে, ভয়ে শারীরিক ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে সে। পাঁচ বছর বয়সে মুখরোচক চিপ্সের স্বাদ পেয়েছিল হানা। তার পর থেকে আর কোনও খাবারই খাওয়ানো যায়নি তাঁকে। কিছু দিন পরে খাদ্যতালিকায় যোগ হয় স্যালাড। ব্যাস, এটুকু খেয়েই দেড় দশক কাটিয়ে দিয়েছেন তিনি।
তবে এতটা সহজ ছিল না দিনগুলো। বন্ধুদের আড্ডায় সহজ ভাবে যোগ দিতে পারতেন না হানা। সব সময় দুশ্চিন্তা থাকত, সেখানে কী খাওয়া দাওয়া হবে, আর সে সব খাবারের সামনে পড়ে কী প্রতিক্রিয়া হবে তাঁর। হানা বললেন, “নানা রকমের খাবার দেখলেই ভয় লাগত আমার। এমনকী খাবার দেখে যে কী করে ফেলব, সে সম্পর্কে নিজের ওপরেই নিয়ন্ত্রণ ছিল না। বন্ধুদের সঙ্গে পার্টি, পিকনিক নানা জায়গায় গেলেও খাবারের আতঙ্ক সব সময় তাড়া করে বেড়াত আমায়।”
কিন্তু চিপ্স জিনিসটা যে কোনও কারণেই হোক অতটা বিপদে ফেলেনি হানাকে। তাঁর কথায়, “একমাত্র সাধারণ চিপ্সই খেতে পারতাম আমি। আসলে নানা রকম মশলার গন্ধই উত্তেজিত করে তুলত।” এ প্রসঙ্গে প্রথম বার প্রেমিকের বাড়িতে যাওয়ার অভিজ্ঞতা জানালেন হানা। বললেন, “ও জানত না আমার অসুখের কথা। প্রথম যখন ওর বাড়িতে গেলাম, আমায় পাস্তা বানিয়ে দিয়েছিলেন ওর মা। কিন্তু মুখে তুলতে পারিনি আমি।” সে সম্পর্ক অবশ্য ভেঙে গিয়েছিল, এই অসুখের কারণে সম্প্রতি ছাড়তে হয় চাকরিও। অনেক ডায়েটিসিয়ান, মনোবিদ দেখিয়েও কোনও কাজ হয়নি। সব মিলিয়ে বাড়ছিল অবসাদ।
কিন্তু উত্তর লন্ডনের সম্মোহন বিশেষজ্ঞ ও মনোবিদ ফেলিক্স ইকোনোম্যাকিসের কাছে যাওয়ার পরেই সমাধানের রাস্তা বেরোল। সম্মোহনকে কাজে লাগিয়ে চিকিৎসা শুরু করলেন তিনি। ফেলিক্স বললেন, “এসইডি আক্রান্ত রোগীদের মূল সমস্যা লুকিয়ে থাকে অবচেতনে। হানার ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছিল। খাবার নিয়ে শৈশবের কোনও খারাপ স্মৃতি ওর সচেতন মনে না থাকলেও অবচেতনে থেকে গিয়েছে। এমনকী ওর বাবা মা-ও এ বিষয়ে কিছু মনে করতে পারেননি। আমি সম্মোহনের মাধ্যমে ওর অবচেতনে ঢুকে সেই খারাপ স্মৃতির উৎসটা খুঁজে বার করার চেষ্টা করি। অতীত খুঁড়ে আতঙ্কটাকে বার করে আনার চেষ্টা করি।”
কলকাতার মনোবিদ প্রশান্তকুমার রায় বললেন, “পুরনো স্মৃতিই যে শুধু এসইডি-র কারণ, তা নয়। বাবা মা নিজেদের অজান্তেই কোনও এক ধরনের খাবারে বাচ্চাকে অভ্যস্ত করে ফেলেন। সেই কারণে অন্যান্য খাবারে অনীহা তৈরি হয় তার। সেই অনীহা এতটাই বেড়ে যায়, যে ‘ওই খাবারটা খেতে ভাল লাগবে না’ এই ভয়েই আর অন্য খাবার খেতে চায় না সে।” সম্মোহন পদ্ধতি এই রোগের ভাল চিকিৎসা এ কথা জানিয়ে তিনি বললেন, “সম্মোহনের মাধ্যমে মূলত সেই তীব্র অনীহার অনুভূতিটা শান্ত করার চেষ্টা করা হয়। বাড়ানো হয় গ্রহণযোগ্যতা। দুশ্চিন্তা, উত্তেজনা প্রশমিত করে রোগীকে বোঝানো হয়, অন্যান্য খাবার খেলেও ভাল লাগবে তার। এ ভাবেই একটু একটু করে অভ্যাস বদলানো হয় তার।”
অবচেতনে লুকিয়ে থাকা আতঙ্কের স্মৃতির সত্যতা নিয়ে অবশ্য প্রশ্ন থেকে যায় বলেই জানালেন প্রশান্তবাবু। বললেন, “অনেক সময়েই রোগীকে এ ভাবে বোঝানো হয়, যে ছোটবেলা থেকে অবচেতনে থেকে যাওয়া এই স্মৃতিই অসুখের কারণ। এটা বুঝিয়ে রোগীকে ভয়মুক্ত করার চেষ্টা করা হয়। ওই স্মৃতির ঘটনা আদৌ হয়তো তার ছোট বেলায় ঘটেনি। কিন্তু সম্মোহন করে ওই স্মৃতিকে খুঁজে বার করার যে আপাত সত্যি পদ্ধতি, সেটাই চিকিৎসার কাজ করে রোগীর মনে। তার পরেই আস্তে আস্তে নানা রকমের খাবারের সঙ্গে অভ্যস্ত করা হয় রোগীকে।”
চিকিৎসা শুরুর প্রথম দিন হানাকে একটি আম খাওয়ান ফেলিক্স। হানা বললেন, “সে দিনই প্রথম আমি আমের স্বাদ পেলাম। এখন আমার সব চেয়ে পছন্দের ফল আম।” আর আমের পরেই পিৎজা। এখনও চলছে চিকিৎসা। তবে গোড়া থেকেই খুব ভাল সাড়া মিলছে চিকিৎসায়। “নিজেকে এখন অনেক সুস্থ মনে হয়। স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পেরে আমি খুব খুশি।” বললেন হানা।